প্রতিদিন সকালে ৩০ মিনিট হাঁটলে গুরুতর অসুখ থেকে মুক্তি মিলবে সহজে

করোনার কঠিন সময়ে থমকে গেছে দেশ, থমকে দাঁড়িয়েছে মানুষের জীবনব্যবস্থা। এই সময়ে ছোট্ট কিছু ‘টনিক’ আপনার স্বাস্থ্য ও শরীর ভালো রাখতে যথেষ্ট। তা হলো—হাঁটা। প্রতিদিন নিয়মিত হেঁটেই নিজেকে সুস্থ রাখতে পারেন। চিকিৎসকদের মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্যে প্রতিদিন সকালে অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা প্রয়োজন। আর এই করোনাকালীন পরিস্থিতিতে, বাড়িতে হাঁটার চেষ্টা করুন; সম্ভব হলে, বাড়ির নিচে খোলা মাঠে হাঁটুন, অথবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পার্কে হাঁটুন।

চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক, প্রতিদিন সকালে হাঁটার কিছু উপকারিতা:

১. দৃষ্টি শক্তি ভালো করে:

প্রতিদিন মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাদের চোখের উপর একটা বিরাট প্রভাব পড়ছে। চোখকে কিছুটা আরাম দিতে এবং চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে প্রতিদিন সকালে হাঁটার বিকল্প নেই। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সকালে খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটলে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে।

২. মানসিক চাপ কমে:

প্রতিদিন হাঁটতে বেড়িয়ে সকালের সুন্দর স্নিগ্ধতা, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে কার না ভালো লাগে বলুন! প্রতিদিন সকালের সুন্দর পরিবেশ ও কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি আপনার মন ভালো করে দিতে পারে নিমিষেই। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের সময় মন স্বাভাবিকভাবেই ফুরফুরে থাকে, শরীর ও মন সতেজ হয়। শরীরের প্রতিটি জয়েন্টে অক্সিজেনের প্রাণপ্রবাহে মাংসপেশীগুলো শিথিল ও রিলাক্সড হয়। প্রতিদিন সকালে কিছুক্ষণ হেঁটে আসলে সারাদিন কাজের উৎসাহ বাড়ে এবং মানসিক চাপ কমে যায়।

৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, বাড়ে সুস্থতা:

প্রতিদিন সকালে হাঁটলে শরীরের প্রতিটি কোষে বিশুদ্ধ রক্ত এবং অক্সিজেন পৌঁছে যায়। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং সহজেই অসুখে পরার প্রবণতাও কমে যায়। পাশাপাশি, যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, ডাক্তারের পরামর্শে তারা নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এতে টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে যায়। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নিয়মিত হাঁটলে ৬০ ভাগ পর্যন্ত কোলন ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। এটা স্বাস্থ্যের জন্যও খুব ভালো।

৪. স্মৃতিশক্তি বাড়ে:

বয়স বাড়ার সঙ্গে সাধারণত মানুষের স্মৃতিশক্তি কমে যায়। ৬৫ বা এর বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রতি ১৪ জনের মধ্যে ১ জনের স্মৃতিভ্রম হয়। আর ৮০ বা এর বেশি বয়সীদের ৬ জনের মধ্যে ১ জনের দেখা দেয় স্মৃতি হারানোর রোগ। নিয়মিত বিভিন্ন ব্যায়াম অনুশীলনে মস্তিষ্কে রক্তচলাচল বাড়ে। এতে স্মৃতিহানি হওয়ার ঝুঁকি ৪০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়। কারণ, সকালে প্রতিদিন কিছুক্ষণ করে হাঁটলে ফুসফুসে তাজা বাতাস প্রবেশ করার সুযোগ পায়। এই বাতাস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে হৃৎপিণ্ড রক্তকে বিশুদ্ধ করে এবং অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত মস্তিষ্কে সরবরাহ করে। ফলে মস্তিষ্ক সচল থাকে এবং স্মৃতিশক্তিও বৃদ্ধি পায়।

৫. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, মেদ কমে:

যদি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তবে প্রতিদিন ৬০০ ক্যালরি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যেটা একদিনের খাবার থেকে প্রাপ্ত ক্যালরির চেয়ে বেশি। যার ওজন ৬০ কেজি তিনি যদি প্রতিদিন ঘণ্টায় ২ মাইল গতিতে ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করেন, তবে ৭৫ ক্যালরি শক্তি ক্ষয় করতে পারেন। যদি ঘণ্টায় ৩ মাইল গতিতে হাঁটতে অভ্যস্ত হন তবে, ৯৯ ক্যালরি পুড়িয়ে ফেলতে পারেন। ঘন্টায় ৪ মাইল গতিতে হাঁটলে আরও বেশি ক্যালরি ক্ষয় করতে পারবেন। এতে ক্যালরি ক্ষয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫০। হাঁটলে দেহের পেশীগুলো আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

৬. জয়েন্টে ব্যথার ঝুঁকি কমে, বাড়ে পেশীশক্তি:

নিয়মিত হাঁটাচলা করলে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথার ঝুঁকি কমে যায়। কারণ, হাঁটলে শুধু পায়ের শক্তিই বাড়ে না পায়ের আঙুলেরও ব্যায়াম হয়। এছাড়া কোমর এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গ নড়াচড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সুস্থ থাকে। সাথে হাঁটার সময় দুহাতও সমান তালে চলে। এতে হাতের প্রতিটি জয়েন্ট, ঘাড় ও কাঁধের ব্যায়াম হয়। ব্যাকপেইনের সমস্যা কমে যেতে পারে নিয়মিত ব্যয়ামের মাধ্যমে।

৭. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে:

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে সকালে নিয়মিত হাঁটলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে, যারা নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করেন তাদের হার্টের অসুখ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়া হাঁটার সময় শরীর থেকে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিআর কমে যায় ও ভালো কোলেস্টেরল এইচডিআর-এর মাত্রা বেড়ে যায়। এছাড়া শরীরের রক্তচলাচল স্বাভাবিক থাকে।

এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের স্ট্রোক এসোসিয়েশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটেন, তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। যাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে, তাদের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ হয়। এছাড়া নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করলে শতকরা ২৭ ভাগ পর্যন্ত উচ্চরক্তচাপজনিত সমস্যা কমে। ফলে হার্টের বিভিন্ন রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়।

এদিকে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করলে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। রক্তের ইনসুলিন ও গ্লুকোজ ক্ষয় হয়। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে। তাই রক্তে চিনির মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে ও স্থূলতার ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষজ্ঞরা।

৮. শরীর ভিটামিন ডি-তে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে:

দিনের আলোতে, বিশেষ করে সকালে হাঁটার অভ্যাস করলে শরীর ভিটামিন ডি-তে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দৈনন্দিন খাবার থেকে খুব অল্প পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ৪ হাজার ৪৪৩ জনের শরীরে ভিটামিন ডি-এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে। দেখা গেছে যাদের শরীরে ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত রয়েছে তারা অন্যদের তুলনায় অন্তত দ্বিগুণ সময় রোগটির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে পারে।

গবেষকরা আরও জানান, ভিটামিন ডি অন্যান্য কোষের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে। এতে ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষ সহজে অন্যকোষে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। এ জন্য হাঁটা হতে পারে উত্তম ব্যায়াম।

পরিশেষে, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার এক জরিপে অংশ নেওয়া ৮৩ ভাগ মানুষ জানিয়েছেন, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করলে মেজাজও নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়। এতে মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। তো, শরীর, স্বাস্থ্য ও মন ভালো রাখতে হলে, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করুন। কারণ, প্রানবন্ত শরীর ও মন, সুখ প্রতিক্ষণ।

পাশাপাশি করোনাকালীন সময়ে, আতঙ্কিত না হয়ে, নিজে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং আশপাশের মানুষকেও সহযোগীতা করুন।

Share this post

scroll to top