ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষার্থী রহিমা সুলতানা। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে সুলতানা পঞ্চম। বাবা আলী আকবর ভূঁঞা ছিলেন পোস্ট মাস্টার (অবসরপ্রাপ্ত)। মা রাজিয়া আক্তার গৃহিণী। সব মা-বাবার স্বপ্ন থাকে সন্তান উচ্চশিক্ষিত হয়ে মুখ উজ্জ্বল করবে, দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করবে। সব বাধা পেরিয়ে সুলতানা তার মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৩৮তম ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন রহিমা সুলতানা।
আনন্দমোহন কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পড়াকালীন সুলতানার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর পড়াশোনায় ভাটা পড়ে। স্বামী শিবলী নোমান কাতার আওকাফে চাকরি করেন। ফলে বিয়ের পর সুলতানাকে কাতারে নিয়ে যান। ২০১৪ সালে কন্যাসন্তানের জন্ম হয় তার। এখন তার সন্তানের ছয় বছর।
দেশের বাইরে থাকায় অনার্সের ক্লাস করতে পারেননি তিনি। যখন পরীক্ষায় সময় হতো তখন পরীক্ষা দেয়ার জন্য দেশে আসতেন। এ অবস্থায় অনার্স শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ে তার। রহিমার আত্মবিশ্বাস ছিল। তাই বিয়ের পর দেশের বাইরে গিয়েও থেমে থাকেননি। উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি।
রহিমা সুলতানা পড়াশোনা আর সংসার চালানোর পাশাপাশি ওমানে ২০১২ সালে বাংলাদেশ স্কুল সোহার (সহকারী শিক্ষক) হিসেবে চাকরি নেন। ২০১৩ সালে ওমানে সোহার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। এরপর (২০১৪-১৫) সালে প্রভাষক হিসেবে ওমানে বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ সাহামে শিক্ষকতা করেন। আবার কাতারে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ এমএইচএম স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন তিনি।
শুরুতে কিশোরগঞ্জের ইটনা আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হয় সুলতানার। তৃতীয় শ্রেণিতে তিনি প্রথম বিদ্যালয়ে যান। এরপর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল হাজি গোলাম হোসেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ‘এ’ গ্রেড পেয়ে এসএসসি পাস করেন সুলতানা। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল মুক্তিযোদ্ধা সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে ব্যবসা শিক্ষায় ‘এ’ গ্রেড পেয়ে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ ২০১০ সালে ইংরেজিতে অনার্স, একই বিষয়ে ২০১১ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন সুলতানা।
রহিমা সুলতানা বলেন, নেত্রকোনার মদন উপজেলার ফতেহপুর গ্রামে আমার জন্ম। বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় বিভিন্ন সময় ট্রান্সফারের কারণে শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায়। আমি কিশোরগঞ্জের ইটনা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে প্রথম ভর্তি হই। এর আগে বাসায় ভাই-বোনেরা আমাকে পড়িয়েছে।
‘তখন পরীক্ষা কী? কিভাবে কি লিখতে হয় কিছুই বুঝতাম না। ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর আমার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা ছিল। কিছুই পড়া হয়নি। তাই পরীক্ষায় খুব খারাপ করেছিলাম। তারপর বড় ভাই-বোনের এবং নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শুরু করি। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করি। ক্লাসের সেরা ফলাফল তখন আমার ছিল। তারপর থেকে ক্লাসে আমি কখনো দ্বিতীয় হয়নি। এরপর মাধ্যমিক শুরু হয় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল গার্লস স্কুলে। সেখানে আমি যথারীতি ৭ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম স্থান অর্জন করি। উপজেলায় চার বছর একটানা শ্রেষ্ঠ ছাত্রী নির্বাচিত হয়ে বৃত্তি পাই’ বলেন সুলতানা।
তিনি বলেন, সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতি হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষার দুইদিন আগে প্রবেশপত্রে দেখি বায়োলজি চলে এসেছে (বাধ্যতামূলক); যা ছিল অতিরিক্ত। এর স্থলে উচ্চতর গণিত (অতিরিক্ত) চলে এসেছে; যা ছিল বাধ্যতামূলক। তখন অতিরিক্ত বিষয়ের গ্রেড পয়েন্ট মূল ফলাফলের সঙ্গে যোগ হতো না। এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাই। এই সময়ে আবার বিষয় পরিবর্তন আসা দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমার সব সহপাঠী বলেছে নিশ্চিত ফেল করব। তারপর দু-একদিনে বড় বোনের সহায়তায় আমি বায়োলজি সম্পর্কে ধারণা নিই এবং পরীক্ষা দিয়ে পাস করি।
তিনি বলেন, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ’র ভর্তি পরীক্ষায় অপেক্ষারত তালিকায় ছিলাম। সেখান থেকে আর ডাক পাইনি। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি তাই আর অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেইনি। পরিবারের কথায় আনন্দ মোহন কলেজে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হই।
সুলতানা বলেন, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি নেই। স্বামী বিদেশে আছেন। আমি ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকতাম। ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষার এক মাস আগে একজন বন্ধুর কাছ থেকে কিছু বইয়ের নাম জেনে তা কিনে দিনরাত পড়াশোনা শুরু করি। তখন আমি ঘরের কাজ এবং মেয়ের যত্ন ছাড়া এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করিনি। মেয়েকে কোলে নিয়ে সারাক্ষণ পড়াশোনা করেছি। তখন প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছি। তারপর ৩৭তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রায় দুই-তিন মাস পাই। এরই মধ্যে মেয়ে অসুস্থ হয়। এজন্য ভারতে চলে যেতে হয় আমাকে। সেখানে যাওয়ার কারণে সময় নষ্ট হয়। লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে এসে ১২ দিন আগে আমার ভগ্নিপতি দুর্ঘটনায় মারা যান। এটা ছিল আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত। তখন আর পড়াশোনা করতে পারিনি। ভাবলাম লিখিত পরীক্ষা আর দেব না। পরিবার বললো চেষ্টা করতে হবে। তারপর পরীক্ষা দিয়েছি। বিষয় আর দেয়া হয়নি। তার আগেই কাতার চলে যাই। কিছু মাস পর লিখিত পরীক্ষায় পাস করি। তখন আমার মৌখিক পরীক্ষা ছিল ডিসেম্বর মাসে।
তিনি বলেন, এর মধ্যে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার জন্য আবেদন করি। কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় আমার হাতে কোনো বই ছিল না। সেখানে আবার ৩৮তম প্রিলির তারিখ ছিল জানুয়ারি মাসে। তাই অনলাইন থেকে সব বই দেখে দেখে আবার পড়াশোনা শুরু করেছি। তারপর ৩৭তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা দেয়ার জন্য এবং দেবরের বিয়ে উপলক্ষে দেশে আসি। তারপর জানুয়ারিতে ৩৮তম প্রিলির পরীক্ষা দিয়ে কাতার চলে যাই। এরপর ৩৭তম পরীক্ষার ফলাফলে আমি নন ক্যাডার সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পাই। বর্তমানে আমি সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবেই আছি।
সুলতানা বলেন, আমার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি বিতর্ক, বক্তৃতা ও রচনা প্রতিযোগিতায় একাধিকবার প্রথম হয়েছি। বিশেষ করে আমার বড় ভাই বগুড়ার পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আশরাফ ভূঁঞা আমাকে বিভিন্ন সময় দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। তার অনুপ্রেরণায় আজ আমি বিসিএস ক্যাডার।
রহিমা সুলতানা বলেন, আমার স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অবদান আমি জীবনেও ভুলব না। তারা সবাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন এবং পড়াশোনার বিষয়ে সব ধরনের সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন থেকে আমি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পেয়েছি। শিক্ষকরা সবাই খুব জ্ঞানী ছিলেন। স্যারদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।
বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যারা বিসিএস পরীক্ষা দেবেন তাদের পরিকল্পনা করে পড়াশোনা করতে হবে। যতক্ষণ সময় পাওয়া যায় ততক্ষণ পড়াশোনায় ব্যয় করতে হবে। কারও নেতিবাচক কথায় কান না দেয়া যাবে না।
পুলিশ সুপার আলী আশরাফ বলেন, ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএস পাওয়ার জন্য অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিল। তাই তার স্বপ্নপূরণ হয়েছে। -জাগো নিউজের সৌজন্যে প্রকাশিত