ঢাকায় একেকটি দুর্ঘটনা ঘটে আর বেরিয়ে আসে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কথা৷ বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের পর জানা গেল ভবনটির নকশা রাজউক অনুমোদিত নয়, নেই ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা৷
আর কয়েক দিন আগে চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর জানা গিয়েছিল অবৈধ কেমিকেল গোডাউনের কথা৷
এখন প্রশ্ন হলো এই অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনা কি আগে জানতে পারে না কর্তৃপক্ষ? যাদের এগুলো দেখার কথা তারা কী করেন? তাদের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অবৈধ সুবিধা যারা দেন, তাদের কি কোনো শাস্তি হয়?
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোনো শাস্তি হয় না৷ হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবনের উদ্বোধন করেছেন দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী৷ অথচ ভবনটি ছিল অবৈধ৷ এই অবৈধ ভবন নির্মাণ এবং তা উদ্বোধনে দুই প্রধানমন্ত্রীকে যারা নিয়ে এসেছেন তারা কারা? দেশের সর্বোচ্চ আদালত ভবনটি অবৈধ ও সরিয়ে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলেও তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির উদ্যোগ নেয়নি৷ কারা মিথ্যা তথ্য দিলো, কারা অবৈধ কাজে সহায়তা করল, তাদের কি শাস্তি হয়েছে?”
তিনি আরো বলেন, ‘‘বনানীর এই ভবনটি অনুমোদন ছাড়াই ১৯ তলা থেকে ২২ তলা করা হলো৷ ফায়ার সিস্টেম নেই৷ এটা এখন বলা হচ্ছে কেন? যাদের এটা দেখার কথা তারা দেখেননি কেন? তাদের কী শাস্তি হবে?”
ঢাকায় এই আগুন, সড়ক দুর্ঘটনা আসলে কোনো দুর্ঘটনা নয়, এগুলো হত্যাকাণ্ড৷ ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বনানীর ঘটনাকে নিজেই হত্যাকাণ্ড বলেছেন৷ তাহলে এই হত্যাকাণ্ড কতদিন চলবে? মানুষ আর কতদিন এভাবে জীবন দেবে? বসবাস করবে মৃত্যুর সঙ্গে? এর দায় কে নেবে?
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এফআর টাওয়ারে মাত্র একটি সিঁড়ি ছিল৷ কিন্তু এই বহুতল ভবনে দুটি সিঁড়ি থাকার কথা৷ একটি সিঁড়ি হবে আগুন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য৷ আইন অনুযায়ী আগুন নিভানোর জন্য নিজস্ব ব্যবস্থা থাকতে হবে, কিছুই ছিলনা৷ ফায়ার সার্ভিস যাওয়ার আগ পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজস্ব টিম থাকতে হবে, ছিলনা৷ আগুন লাগার পর সবাই ছুটেছেন৷ আর ভবনে ছিল দাহ্য পদার্থ৷ ফলে যা হওয়ার হয়েছে৷”
আইনের ফাঁকে কে সুবিধা নেয়?
ফায়ার সার্ভিসের আইন অনুযায়ী ছয় তলার বেশি উঁচু ভবন করলেই তাদের অনুমোদন নিতে হবে৷ আর থাকতে হবে নিজস্ব ফায়ার ব্যবস্থাপনা৷ কিন্তু রাজউকের আইনে ১০ তলা পর্যন্ত ফায়ারের অনুমোদন লাগেনা৷ এই সুযোগটি নেয় ভবন মালিকরা৷ রাজউকের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এই আইনের সুবিধা দেয়ার জন্য রেডি থাকেন৷ ১০ তলার পরে ভবন আরো যখন উঁচু করা হয় বা আরো তলা বাড়ানো হয় তখন ভবন মালিকরা পুরনো ভবনেরই সম্প্রসারণ দেখান৷ ফায়ার সার্ভিসের ধারে কাছেও যান না৷ এফআর টাওয়ার ১৯ তলা থেকে ২২ তলা হয়েছে এইভাবেই৷ তারা রাজউকের নকশাও মানেনি৷ ফায়ার সার্ভিসতো দূরের কথা৷
মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘‘ভবনতো আর গোপনে নির্মাণ করা যায় না৷ এটা প্রকাশ্যেই হয়৷ মাটির এক কিলোমিটার নিচে তৈরি করা হলেও তা স্যাটেলাইটে ধরা পড়ে৷ তাহলে এটা কীভাবে হলো? এটা সমঝোতার মাধ্যমেই হয়েছে৷”
আর শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘‘আমাদের কোনো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই, যে আটকাবো৷ আর আমরা মামলা করলে উলটো আমাদের মামলায় নাস্তানাবুদ করা হয়৷ আর এখানে সমন্বয়ের অভাব আছে৷”
পরিস্থিতি কেমন?
ফায়ার সার্ভিস ঢাকা শহরের বহুতল (৬ তলার উপরে) ভবনগুলোর আগুনের ঝুঁকি নিরূপণ করে নিয়মিত৷ আর যেসব ভবন আগুনের ঝুঁকিতে আছে তাদের নোটিশ দিয়ে ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা আপডেট করতে বলে৷ কিন্তু খুব সামান্যই সাড়া পাওয়া যায়৷ নোটিশ পাওয়ার পর কোনো ভবন মালিক হয়তো একটি ফায়ার এক্সটিঙ্গুইসার লাগালো এই পর্যন্ত৷
শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘‘আমরা কমপক্ষে ৫ হাজার ভবন মালিককে নোটিশ দিয়েছি৷ বিশেষ করে মার্কেট, শপিং মল, অফিস, হাসপাতাল যেগুলো বেশি ভালনারেবল৷ এইসব ভবনের যা অবস্থা তাতে এগুলো মৃত্যুকূপ৷ যারা ওই সব ভবনে আছেন তারা মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস করছেন৷ আমরা বারবার বলার পরও ভবন মালিকরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না৷”
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ঢাকা শহরের ৪২৩টি হাসপাতালের মধ্যে ৪১৬টিই ভয়াবহ আগুনের ঝুঁকিতে আছে৷ ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, মার্কেট, আবাসিক হোটেলসহ তিন হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ভয়াবহ আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে৷ ঢাকার মাত্র ৫টি মার্কেট ও শপিং মলের আগুন ব্যবস্থাপনা সন্তোষজনক৷
২০১২ সালে ফায়ার সার্ভিস, ডেসা, ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন দেয়া ১১২টি ভবনে বুয়েটের করা গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র দুটি ভবন তাদের সব নির্মাণ নীতিমালা মেনেছেন৷ বাকিরা কোনো না কোনো নিয়ম এড়িয়েছেন, অথবা মানলেও তা অকার্যকর৷
২০১৬ সালে ড্যাপ-এর করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকা শহরে সাততলা বা তার চেয়ে উঁচু ভবন আছে ১৬ হাজার ৯৩০টি৷ স্বাভাবিক নগরায়ন ও উন্নয়নের কারণে গত দুই বছরে এর সংখ্যা আরো ১০-১৫ ভাগ বেড়েছে৷ আইন অনুযায়ী এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক৷ কিন্তু ফায়ার সার্ভিস থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ৫ হাজার ২৪টি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নেয়া হয়েছে৷ তাহলে এটা স্পষ্ট যে দুই তৃতীয়াংশের বেশি বহুতল ভবনের ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেই৷ আর ৮০ ভাগ ভবনই কোনো না কোনোভাবে নিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন করে নির্মাণ করা হয়েছে৷
একাধিক সূত্র জানায়, কীভাবে এসব ভবন নির্মাণ হয়েছে তার কয়েকটি ধরে অনুসন্ধান করলেই আসল কাহিনি বেরিয়ে আসবে৷ জানা যাবে চক্রের কথা৷ আর তাও সম্ভব না হলে শুধু এফআর টাওয়ারের ১৯ তলা থেকে ২২ তলা হওয়ার ঘটনা সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলেও সব কিছু স্পষ্ট হবে৷
দায় নেবে কে?
এফআর টাওয়ারের ঘটনায় তখনকার রাজউক চেয়ারম্যানকে খোঁজা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ তিন দিনের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট দিলেই আমরা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব৷ আমরা শুধু তদন্ত রিপোর্টেই সীমবদ্ধ থাকবনা৷”
আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা ঢাকার সব ভবন পরীক্ষা করব৷ সরেজমিন পরিদর্শন করব৷ ভবনগুলোকে নাম্বারিং করব৷ কোন ভবনের নকশায় ত্রুটি, কোনটার ফায়ার সিস্টেমে ত্রুটি তা চিহ্নিত করব৷ এরপর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ আর সামনের সপ্তাহেই কাজ শুরু হবে৷”
মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘‘ঢাকা শহর একটি বোমার উপরে আছে৷ আগুনেই এই অবস্থা৷ আর যদি ৬ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয় তাহলে এখানকার গ্যাস, বিদ্যুৎ লাইন বিপর্যয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে৷ অধিকাংশ ভবনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেনা৷ প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয়, হাসপাতাল সব বিপর্যয়ের মুখে পড়বে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘ভবিষ্যতে কী করব তার চেয়ে জরুরি হলো যে অনিয়ম হয়েছে তা চিহ্নিত করে দায়ীদের বিচার করা৷ তাহলে ভবিষ্যৎ এমনিতেই ভালো হবে৷”
সূত্র : ডয়চে ভেলে