শুরুটা হয়েছিল ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের পুলওয়ামায় হামলাকে কেন্দ্র করে। এরপর একে অপরকে হামলার মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু এখন কেন পাক-ভারত যুদ্ধ? এ ঘটনার অনুসন্ধানমূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন তুরস্কের সাংবাদিক ইব্রাহিম কারাগুল। বার্তা সংস্থা ইয়ানি শাফাকে প্রকাশিত ওই বিশ্লেষণের সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরা হলো।
মুসলিম বিশ্বের উচিত নয় চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, বিশ্বের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলা। আটলান্টিক মহাসাগরের তীর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত মুসলিমদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাধানোর পাশ্চাত্যের পাতা ফাঁদে পা না দেয়া। বিশ্বব্যাপী নিজেদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পাশ্চাত্য তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোকে দুর্বল করতে মুসলমানদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে এবং একই সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে চায়।
মুসলিম বিশ্বের জন্য দরকার নিজস্ব শক্তিবলয়
স্থানীয় দ্বন্দ্ব, বিরোধ, ক্ষোভ, বিরক্তি ও দুর্বলতায় জড়ানোর পরিবর্তে মুসলিম বিশ্বের উচিত একুশ শতাব্দীকে আকৃষ্ট করার মতো প্রকল্প, নিজেদের ভবিষ্যৎ তৈরির উপায় ও নিজেদের প্রভাব বলয় নিয়ে ভাবা। এটি করতে ব্যর্থ হলে তাদেরকে এই শতাব্দীকে হারাতে হবে। বিশৃঙ্খলা অব্যাহত থাকবে যেমনটা এখন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে।
আপনি কি পাক-ভারত সঙ্কটকে বিবেচনায় নিচ্ছেন? পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দু’টির মধ্যে স্বাধীনতার পর থেকে কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে। কখনো কখনো যুদ্ধ ছিল না, কিন্তু সবসময় তাদের মধ্যে সংঘর্ষ, বিক্ষোভ, গোপন গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। উভয় দেশের অস্ত্রসম্ভার গড়ে তোলা, তাদের সামরিক মতবাদ সব এ দ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে। পারমাণবিক শক্তি অর্জনও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
পাক-ভারত যুদ্ধের লক্ষ্য কী?
অবশ্য গত মাসের ঘটনাগুলো এর বাইরে অর্থ বহন করে। প্রথম হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল ইরানে। এরপর ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে। একটিতে ইরানি বিপ্লবী গার্ড ও অন্যটিতে ভারতীয় সৈন্যরা লক্ষবস্তু ছিল। উভয় দেশই হামলার জন্য পাকিস্তান দায়ী বলে অভিযোগ করে। পরে ভারতের জঙ্গিবিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করলে দু’টিকে ভূপাতিত করা হয়। বন্দী করা হয় একটি বিমানের পাইলটকে। পাকিস্তান তার পুরো আকাশ পথ বন্ধ করে দেয়। ভারতও ওই এলাকার আকাশ বিমান চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেয়। তারা এক সপ্তাহে যুদ্ধের প্রায় কাছাকাছি ছিল।
কিন্তু এটি পাক-ভারত যুদ্ধ নয়
হ্যাঁ, এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে চীনের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা বিরুদ্ধে ‘শাস্তি’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তানকে কোণঠাসা করা ও আত্মসমর্পণ করতে বলা বলার অভিপ্রায়ও এ ঘটনার নেপথ্যে থাকতে পারে। সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুতর পারমাণবিক হুমকি সৃষ্টি হতে পারে। এর অর্থ হলো পাশ্চাত্যকে শক্তিশালী করা ও এশিয়া শক্তিহীন করা। কিন্তু আমার তত্ত্বটি এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তিন দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য ও পাশের অঞ্চলে এবং তুরস্কের বিরুদ্ধে যা করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপের মধ্যে আদতে কোনো পার্থক্য নেই। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফাঁদ পাতা হয়েছে। এটি এমন বিষয় যা কেবল ভারত ও পাকিস্তানের দুর্বল ক্ষেত্রগুলোতে সীমাবদ্ধ নয়। দুর্বলতা শুধু একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি যাকে ব্যবহার করে বৃহত্তর ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, অথচ আমাদের এ অঞ্চল কখনো তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়নি।
পূর্ব থেকে মুসলিম বিশ্বকে অবরোধ
এর অর্থ হচ্ছে বিশ্বের পূর্বাঞ্চল থেকে মুসলিম অঞ্চল বা বিশ্বকে অবরোধ করা। সভ্যতার লড়াইয়ে বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার সাথে মুসলিম সভ্যতার লড়াই লাগিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তারা এটি করতে চাচ্ছে। আমাদের (মুসলিম জাহান) ও বিশ্বের প্রতি মারাত্মক একটি হুমকির ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আমি নি¤েœর বিষয়গুলো তুলে ধরছি এক নিবন্ধে। আমার ওই নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘মুসলিম অঞ্চলকে পূর্ব থেকে অবরোধ করা, মুসলমানদরেকে বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা।’ পশ্চিমাঞ্চল থেকে ইসলামকে অবরোধ করা হয়েছে। এখন দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকেও অবরোধ করা হচ্ছে? যাতে বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার সাথে মুসলমানরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। খ্রিষ্টান ও উগ্রবাদী ইহুদিদের নির্দেশনায় হিন্দু ও বৌদ্ধরা কি মুসলমানদের ওপর হামলা চালাতে যাচ্ছে? ইসলাম কি সব সভ্যতার জন্য একটি সাধারণ সমস্যায় পরিণত হতে যাচ্ছে? মুসলমানদের সাথে পশ্চিমা, ইহুদি ও খ্রিস্টান সভ্যতার সংঘর্ষের পাশাপাশি বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতাও কি এখন ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অগ্রসর হচ্ছে? এরকম হাজারো প্রশ্ন এখন সামনে চলে আসছে।
মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে পশ্চিমা রাজনৈতিক মনোভাব ও উপলব্ধি থেকেই এসব হুমকির জন্ম হয়েছে। তারা অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করলে এটি আসলে পুরোপুরি সভ্যতার লড়াই। পশ্চিমের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পশ্চিমা হস্তক্ষেপ আদতে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যত দিন পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যাঞ্চল পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণে না যাবে তত দিন পর্যন্তু তারা এ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আধিপত্য বজায় রাখতে তারা আর কোনো নতুন পদক্ষেপ নিতে পারবে না। সম্ভবত এই প্রথম পশ্চিমা জগত তাদের আধিপত্য হারানোর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিম থেকে অবরোধ ও পূর্বে কোণঠাসা করা
এ কারণেই মুসলিম অঞ্চলের ওপর হামলার সময় তারা অন্য সভ্যতার বিরুদ্ধে মুসলমানদের ব্যবহার করতে অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। দুর্ভাগ্যবশত তারা দুর্বলতা ও সংবেদনশীলতার পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের ক্রোধ ও সংগ্রামের উন্নততর ক্ষেত্রগুলোও ব্যবহার করছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা হচ্ছে পূর্ব অঞ্চলের একটি সভ্যতার যুদ্ধ হিসেবে। এটি হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হচ্ছে। তাই এটি এ দু’টি দেশের মধ্যে সাধারণ সমস্যাগুলোর বাইরে একটি নতুন সঙ্কট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এটি হবে ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ
এমন ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পক্ষে ভারত ও পাকিস্তানের কি যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু এই যুদ্ধ ভয়াবহ ধ্বংস ডেকে আনবে। এ ধরনের যুদ্ধ লিপ্ত হলে একটি ‘পশ্চিমা তত্ত্ব’ বাস্তবায়ন হবে; যা মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তকে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া এবং মুসলমানদের এমনভাবে তুলে ধরা যে, ইসলাম হচ্ছে সব সভ্যতার জন্য সাধারণ সমস্যা। এ জন্য মুসলিম বিশ্বের উচিত হবে না ভারত ও চীনের সাথে কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া। সঙ্ঘাতে বিক্ষত বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্ঘাতেও মুসলমানদের জড়ানো উচিত হবে না। কাশ্মির সমস্যা আছে এবং একইভাবে আছে পূর্ব তুর্কিস্তানের সমস্যা। আমাদের কেউ কেন তাদেরকে রক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে না, এমন প্রশ্ন প্রায় আমি শুনতে পাই।
সূত্র : ইয়ানি শাফাক,অনুবাদ-মোস্তাফিজুর রহমান