সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার হাওরগুলোতে সোনার ফসল সংগ্রহে কৃষকরা ধান শুকানোর জন্য হোড়া (অস্থায়ী বসতি- স্থানীয় ভাষায় হোড়া বলা হয়) তৈরি করেছেন। বাড়ি থেকে জমির দুরত্ব বেশী থাকার কারণে ধান সংগ্রহ ও তদারকি করার জন্য হোড়ায় বসতি শুরু করেছেন কৃষকরা। বৈশাখ মাসের শুরুতেই এক ফসলী বোরো ধান ঘরে তোলার জন্য কৃষকের প্রাণপন চেষ্টা, সারাদিন ঘাম ঝরানা কষ্ট। সব কষ্টই যেন আনন্দে পরিনত হয় সোনাবরণ ধানগুলো গোলায় তুলতে পারলেই। তবে এর মাঝে আছে প্রকৃতির বৈরী আচরণ কালবৈশাখী ঝড় ও শীলাবৃষ্টির আতঙ্ক।
কালবৈশাখী ঝড়, শীলাবৃষ্টি, বোরো ধানে চিটাসহ নানান কারনে এবারও জেলার দিরাই, শাল্লা, তাহিরপুর,জামালগঞ্জ, ধর্মপাশাসহ ১১টি উপজেলার হাওরগুলোতে কষ্ট করে ফলানো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মাঝে আছে শ্রমিক সংকট। ফলে কৃষকরা দিশেহারা। এসবের মধ্যেও থেমে নেই হাওর পাড়ের সংগ্রামী কৃষকরা। অতিরিক্ত টাকা দিয়ে হলেও শ্রমিক নিয়োগ করার চেষ্টা করেছেন নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে। আর ইতোমধ্যেই পুরোদমে শুরু হয়েছে ধান কাটা। ধান কাটতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
হাওরের কৃষক সাদেক আলী জানান, তার কোনো জমি নেই। তাই বছরের খাবার জোগাড় করতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শনির হাওরে এক খণ্ড অনাবাদি উঁচু জমিতে ছন ও বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী ছোটঘর (স্থানীয় ভাষায় হোড়া) বানিয়েছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে এ হাওরেই রাত্রীযাপন করছেন। কৃষিকাজে স্বামী-স্ত্রী মিলে অন্যর জমির ধানকাটা, মাড়াই, ঝাড়া, শুকানোর কাজ করছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ধান ঘরে তোলার জন্য হাওরে শতাধিক ছোট ছোট অস্থায়ী ঘর রয়েছে। বিশাল হাওরের এক কোনায় অস্থায়ী ছনের ঘরে রাত্রিযাপন করার জন্যই হোড়া তৈরি করা হয়েছে। ঝড়বৃষ্টি না হলে সারারাত হাওরেই কাটান তারা। এছাড়া অনেকেই আবার ঝড়বৃষ্টি এলেও অস্থায়ী ঘরে সৃষ্ঠিকর্তার ওপর ভরসা করেই রাত কাটান।
এখানে কৃষিকাজের পাশাপাশি রান্নার জন্য চুলা বানিয়ে রান্না-বান্না করছেন তারা। থাকা খাওয়া বিশ্রাম সব কিছু হচ্ছে হাওরের ছোট এই ঘরটিতেই। হাওরের উঁচু জায়গাতে ধান পরিবহন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কৃষকরা অস্থায়ী ছোট ঘর বানিয়ে রাত্রিযাপন করছেন। অনেক দরিদ্র মানুষ এই সময়টাতে কষ্ট করে হলেও কৃষকের ধান সংগ্রহ করে উপকৃত হচ্ছেন।
মাটিয়ান হাওরের ভাটি তাহিরপুর গ্রামের কৃষক সামায়ুন কবির জানান, সবে মাত্র ধান কাটা শুরু করেছি। ধান শুকানো ও তদারকি করার জন্য খলার পাশে ঘর তৈরি করেছি। রাতে এই ঘরেই থাকি। ফসল পুরোপুরি ঘরে না তোলা পর্যন্ত এখানেই থাকবো। ধান ঘরে তোলার জন্যই আমাদের এত প্রচেষ্টা।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের কৃষক শফিক মিয়া জানান, বাড়ি থেকে হাওরের জমির দূরত্ব অনেক বেশী হওয়ায় এখন কেবল ধান কেটে মাড়াই করে বস্তাবন্দি করে রাখছেন। পরে গাড়িতে করে ধান বাড়ি নিয়ে যাবেন। তাই হাওরে অস্থায়ী হোড়া বানিয়ে বসতি স্থাপন করে এখন সেখানেই থাকছেন। রান্না, খাওয়া সব কিছুই এখন হাওরে।
তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুছ ছালাম বলেন, চলতি বছর তাহিরপুর উপজেলার ২৫টি ছোট বড় হাওরে ১৮হাজার ২শ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করা হয়েছে। হাওরে এখন পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। শীলাবৃষ্টিসহ বিভিন্ন কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এরপরও এখন ধান ঘরে তুলতে সবাই ব্যস্ত সময় পার করছেন। ধান সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কৃষকরা এখন হোড়ায় বসতি স্থাপন করেছেন। আশা করছি ফসল ঘরে তুলতে পারলে কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ কমবে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, শীলাবৃষ্টিতে ধানের ক্ষতি হলেও হাওরে বাকি ধান তোলা নিয়ে কৃষকদের মধ্যে অন্যরকম উৎসাহ উদ্দীপনা বিরাজ করছে। উপজেলার বেশি সংখ্যক হাওরেই এখনও শ্রমিক সংকট রয়েছে। তারপরও আশা করছি ভাল ভাবেই ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কৃষকরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর সুনামগঞ্জ জেলায় ১১টি উপজেলার ছোট বড় সবকটি হাওরে ২লাখ ২৪হাজার ৫শত ৫২হক্টর বোরো জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ১৪লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হওয়ার কথা। যার বাজার মূল্য হবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।