যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের মুসলিম মহিলা সদস্য ইলহান ওমরকে ঘিরে গত কদিন ধরে চলছে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক। নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে তার এক মন্তব্যের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে তাকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি এই বিতর্ককে উস্কে দিয়েছে আরও। ইলহান ওমরের পক্ষে এবং বিপক্ষে তীব্র বাদানুবাদ চলছে রাজনীতিতে এবং গণমাধ্যমে।
ইলহান ওমর তার এক ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাইন ইলেভেনের হামলার প্রসঙ্গ টেনেছিলেন এবং এই হামলাকে ‘সাম পিপল ডিড সামথিং’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। এরপর তিনি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ভিডিওর পাশাপাশি ইলহান ওমরের মন্তব্য জুড়ে দিয়ে সেটি টুইট করেন।
রিপাবলিকানরা অভিযোগ করেন, ইলহান ওমর নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলাকে হালকাভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে ডেমোক্রেটরা ইলহান ওমরকে সমর্থন করে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইলহান ওমর এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উস্কানি দিচ্ছেন। ঠিক কিভাবে এই বিতর্কের শুরু এবং কেন এটি এত উত্তেজনা তৈরি করেছে মার্কিন রাজনীতিতে?
ইলহান ওমর কে?
গত নভেম্বরের নির্বাচনে মিনেসোটার একটি আসন থেকে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের সদস্য নির্বাচিত হন ইলহান ওমর। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম দুজন মুসলিম মহিলা কংগ্রেসের সদস্য হন, ইলহান তাদের একজন। তিনি হচ্ছেন প্রথম কংগ্রেসের প্রথম কোন মহিলা সদস্য, যিনি হিজাব পরেন।
ইলহান ওমরের পরিবার সোমালিয়া থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আসেন। কংগ্রেস সদস্য হিসেবে শুরু থেকেই ইলহান ওমরকে ঘিরে শুরু হয় বিতর্ক। ইসরায়েল এবং ইসরায়েলপন্থী লবি নিয়ে মন্তব্যের কারণে তাকে ‘অ্যান্টি সেমেটিক’ বা ইহুদী বিদ্বেষী বলে বর্ণনা করেন ডানপন্থী সমালোচকরা। পরে অবশ্য ইলহান ওমর তার মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
একজন মুসলিম কংগ্রেস সদস্য হিসাবে ইতোমধ্যে তিনি নানা ধরণের হুমকিরও মুখে পড়েছেন। তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়ায় নিউ ইয়র্কের পুলিশ সম্প্রতি ৫৫ বছর বয়সী এক লোককে গ্রেফতার করে। এই লোকটি ইলহান ওমরকে সন্ত্রাসী বলে বর্ণনা করেছিল।
কী বলেছিলেন ইলহান ওমর?
‘সাম পিপল ডিড সামথিং’ বা কিছু লোক কিছু একটা করেছিল’ কথাটি ইলহান ওমর সম্প্রতি দেয়া এক বক্তৃতায় বলেছিলেন। গত ২৩ মার্চ তিনি কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্সের সভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। ২০ মিনিটের ঐ ভাষণে তিনি ইসলামোফোবিয়া থেকে শুরু করে সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের মসজিদে সন্ত্রাসবাদী হামলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলেন।
এক পর্যায়ে তিনি কথা বলছিলেন, নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসবাদী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের কী ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
“এই হচ্ছে প্রকৃত সত্য। বহু দিন ধরে আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে একটা অস্বস্তি নিয়ে বসবাস করতে হয়েছে এবং সত্যি কথা বলতে কি, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই দেশের প্রতিটি মুসলিমেরও তাই হওয়া উচিৎ। নাইন ইলেভেনের পর কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স স্থাপন করা হয়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল, কিছু লোক কিছু একটা করেছে এবং এখন আমাদের সবাই নাগরিক অধিকার হারাতে শুরু করবো।”
কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স আসলে স্থাপিত হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এই তথ্যটি যাচাই করে প্রকাশ করার পর ইলহান ওমরের একজন মুখপাত্র অবশ্য বলেন, তিনি ভুল বলেছেন এবং তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন নাইন ইলেভেনের হামলার পর এই সংগঠনের আকার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
এই বির্তক কীভাবে ছড়ালো?
ইলহান ওমরের এই বক্তৃতা গত ৯ এপ্রিল থেকে সবার মনোযোগ কাড়তে শুরু করে। কারণ টেক্সাসের এক রিপালিকান কংগ্রেস সদস্য ড্যান ক্রেনশ তার বক্তৃতাকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে বর্ণনা করেন। এরপর বিষয়টি লুফে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স নিউজ সহ অন্যান্য রক্ষণশীল মিডিয়া, তারা এটা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান ইলহান ওমরকে ‘অ্যান্টি আমেরিকান’ বলে বর্ণনা করেন।
এর পাল্টা ইলহান ওমর একে ‘বিপদজনক উস্কানি’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কারণ আমি এখনই মৃত্যুর হুমকির মধ্যে আছি।’ ইলহান ওমর নাইন ইলেভেনের ব্যাপারে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের একটি মন্তব্য পোস্ট করে বলেন, তিনিও কী তাহলে নাইন ইলেভেনের হামলাকে খাটো করে দেখাচ্ছিলেন?
এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে নিউ ইয়র্ক পোস্ট। তারা পত্রিকার প্রথম পাতায় নাইন ইলেভেনের হামলার একটি ছবি প্রকাশ করে ওপরে হেডলাইন দেয়: ‘হিয়ার ইজ ইয়োর সামথিং।’
নিউ ইয়র্ক পোস্টের এই শিরোনাম বিতর্কটিকে আরও তিক্ত করে তোলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এর পক্ষে বিপক্ষে শুরু হয় তর্ক। নাইন ইলেভেনের ছবি ব্যবহারের জন্য অনেকে পত্রিকাটির সমালোচনা করে। নিউ ইয়র্কের যে কর্নার শপগুলোতে পত্রিকা বিক্রি হয়, যেগুলোর বেশিরভাগই ইয়েমেনিরা চালায়, তারা পত্রিকাটি বর্জনের ঘোষণা দেয়।
এই বিতর্ককে কীভাবে দেখছে মানুষ
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই এই বিতর্কে ইলহান ওমরকে সমর্থন দিচ্ছেন। শুক্রবার টুইটারে ‘স্ট্যান্ড-উইথ-ইলহান’ হ্যাশট্যাগটি ট্রেন্ড করছিল। ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকরা ইলহানের সমর্থনে এগিয়ে আসেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন প্রার্থী এলিজাবেথ ওয়ারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একজন নারী কংগ্রেস সদস্যের বিরুদ্ধে সহিংসতায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগ তোলেন।
আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ইলহান ওমরের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ ‘ন্যাক্কারজনক এবং বিপদজনক।’