ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার ছাদে আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত। দ্বগ্ধ রাফির দেয়া তথ্যানুযায়ী, এখনো হামলাকারীদের শনাক্ত করা যায়নি। তবে ওই ঘটনায় সন্দেহভাজন আটককৃত দুইজনকে সোমবার আদালতের মাধ্যমে জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে। আটক করা হয়েছে আরো ৭ জনকে।
রাফির ভাই বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ৪ জনকে আসামী করে মামলা দিয়েছেন। একইসাথে ঘটনার আগে বিভিন্ন সময়ে হুমকি-প্রদানকারী চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরা সবাই মাদরাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার ঘনিষ্ঠভাজন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে স্থানীয়রা জানায়, মাদরাসার ভিতর ও বাইরে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা একটি বলয় তৈরি করেছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারীর পাশাপাশি বর্তমান ও সাবেক ছাত্র রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে মাদরাসা তহবিল থেকে নানা কায়দায় সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। একইভাবে প্রভাবশালী একটি মহলের সাথেও রয়েছে তার দহরম-মহরম।
ফলে অত্র মাদরাসায় দায়িত্বকালীন সময়ে তহবিল তসরুপ, নারী কেলেংকারীসহ অনিয়ম-দূর্নীতির নানা অভিযোগ উঠলেও শেষপর্যন্ত তাকে কাবু করা যায়না। ২৭ মার্চ আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে নিজকক্ষে ডেকে এনে অগ্রিম প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভনে অনৈতিক প্রস্তাব ও যৌন হয়রানির ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগির মা শিরীন আক্তার।
পরদিন গ্রেফতার হয়ে জেল-হাজতে যান অধ্যক্ষ সিরাজ। এ ঘটনায় সোনাগাজী মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও যখন সিরাজের বিচার দাবীতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন কর্মসূচী করেন তখন সিরাজের সাঙ্গরাও তার মুক্তি দাবীতে মাঠে নামেন পাল্টা কর্মসূচী নিয়ে। এদের সঙ্গে সিরাজের পরিবারের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলেও তদন্তকারী সূত্রের কাছে তথ্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, মামলাটি তুলে নিতে রাফি, তার মা ও ভাইকে বারবার হুমকি-ধমকি দেয়া হয়।
৬ এপ্রিল শনিবার এর ঘটনায় সোমবার দায়ের করা মামলায় এদের অন্তত ৪ জনের নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এরা হলো মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নুর উদ্দিন, জাবেদ ও মহিউদ্দিন শাকিল।
বাদী মাহমুদুল হাসান নোমানের ভাষ্য অনুযায়ী, এরা সহ অজ্ঞাতনামা অনেকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি-ধমকি প্রদান করে। হুমকিদাতাদের সহযোগিতায় তার বোনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ওই চারজন রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত।
ইতোমধ্যে পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও গণমাধ্যম কর্মীরা সোনাগাজীতে ঘটনার অনুসন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরলেও এ ব্যাপারে প্রকাশ্য কেউ মুখ খুলতে রাজি হননা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাদরাসার একাধিক শিক্ষক জানান, সিরাজ উদদৌলা কারাবন্ধী থেকেও গ্রেফতার পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং যে কোন মূল্যে মামলা তুলে নেয়ার জন্য তার নির্দেশনা ছিল। ওই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে তার সাঙ্গরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। অব্যাহত চাপ প্রয়োগের পরও মামলা তুলতে রাজি না হওয়ায় রাফির এই ভয়ানক পরিণতি বলে তাদের ধারণা।
ওই শিক্ষক আরো জানান, ঘটনা সম্পর্কে তথ্য থাকলেও অজানা আতঙ্কে কেউ মুখ খুলতে চায়না। শোনা যাচ্ছে, ঘটনার আগের রাতে মাদরাসার ছাত্রাবাসে বহিরাগতদের আনাগোনা ছিলো। সেখান থেকেই ঘটনার পরিকল্পনা হতে পারে বলে তাদের ধারনা।
তারা মনে করছেন, ছাত্রাবাসে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ ব্যাপারে তথ্য মিলতে পারে। তারা আরো জানান, মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই অধ্যক্ষ সিরাজ কয়েকমাস আগে এই ছাত্রাবাস খুলেছেন। এখানে ছাত্রদের পাশাপাশি বহিরাগতদের আনাগোনা সবসময় দেখা যায়। এমনকি অধ্যক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অনেকেই ছাত্রাবাসের মেসে খেয়ে থাকেন।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, এমন পরিস্থিতিতে পুলিশি হয়রানি কিংবা গ্রেফতার এড়াতে কেউ কেউ গা ঢাকা দিলেও সিরাজের লোকজন সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। এমনকি থানাতেও তাদের আনাগোনা দেখা যায়। পরীক্ষা কেন্দ্রে সংরক্ষিত এলাকায় এমন বর্বর ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ওদের কেউ কেউ পুলিশ ও সাংবাদিকদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন।
এদিকে ঘটনা তদন্তে সোনাগাজী মডেল থানার পাশাপাশি জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম মাঠে রয়েছে। ওসি মো: রাশেদ খান চৌধুরী জানান, গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ফেনী শহরের সদর হাসপাতাল এলাকা থেকে গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে মাদরাসার নিরাপত্তা প্রহরী মো. মোস্তফা, মাদরাসা থেকে অফিস সহকারী ও অধ্যক্ষের ফুফা শ্বশুর নুরুল আমিনকে আটক করা হয়। এছাড়া আলাউদ্দিন, হোনা মিয়া ও সাইফুল নামের তিনজনকে বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করা হয়েছে। সন্ধ্যায় কুমিল্লা থেকে আটক করা হয় কেফায়েত উল্লাহকে।
পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম বলেন, সোমবার দুপুরে রাফির ভাই নোমান বাদী হয়ে থানায় মামলা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকৃত আসামীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
শম্পাকে খুঁজছে পুলিশ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন নুসরাত জাহান রাফি ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ (মৃত্যুশয্যায় দেওয়া বক্তব্য) দিয়েছেন। চিকিৎসকদের কাছে দেয়া বক্তব্যে রাফি জানায়, নেকাব, বোরকা, হাতমোজা পরিহিত চারজন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই চারজনের একজনের নাম ছিল শম্পা।
অন্য কারো নাম বলতে পারেনি রাফি। শম্পাই তাকে শ্রেণিকক্ষ থেকে ডেকে ছাদে নিয়েছিল। রাফির দেয়া তথ্য অনুযায়ী শম্পাকে খুঁজছে পুলিশ। সোমবার মাদরাসায় আলিম পরীক্ষার্থী শিক্ষার্থীদের তালিকা সংগ্রহ করে পুলিশ তাদের খোঁজখবর নিচ্ছে। এদের মধ্যে কারো ডাক নাম শম্পা আছে কিনা তা যাচাই করছে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এখনো খোঁজ মিলেনি বলে পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশের ওই সূত্র আরো জানায়, শম্পাকে খুঁজে পেলে ঘটনায় প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে।
মাদরাসার অনুদান হস্তান্তর
অগ্নিদ্বগ্ধ নুসরাত জাহান রাফির চিকিৎসার্থে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পিকেএম এনামুল করিম সোমবার দুপুরে ২ লাখ টাকার চেক জেলা প্রশাসক মো: ওয়াহিদুজজামানের হাতে তুলে দেন। জেলা প্রশাসক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হোসাইন আহম্মদের হাতে অনুদানের চেক হস্তান্তর করেন।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হোসাইন আহম্মদ জানান, সন্ধ্যায় তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাফিকে দেখতে যান। সেখানে তার বাবার একেএম মুসার হাতে চেক তুলে দেন। এসময় তারা রাফির সুস্থতা কামনায় দোয়া ও মুনাজাত করেন।