ট্রলারডুবিতে শেষ হয়ে গেল সংসারে উপার্জনের উৎস

উপুড় হয়ে পড়ে আছে ইউনিফর্ম পরা লাশটি। এক হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন কোমরে রাখা অস্ত্রটি। নদীর মোহনার তীরে কাঁদা পানি, পাশে জঙ্গল। লাশটি প্রথম দেখাতেই ডুকরে কেঁদে উঠেন চর ধলেশ্বরীর বৃদ্ধ মমতাজ উদ্দিন। কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আহারে ভোট… আহারে মানুষ… আহারে জীবন’।

গত ২ এপ্রিল ট্রাফিকের নারায়ণগঞ্জ শহর উপ-পরিদর্শক (টিএসআই) সেলিম মিয়ার লাশ উদ্ধারের খবর এটি। পরে বন্দর কলাগাছিয়া ফাড়ি পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে। এ সময় তাঁর সরকারি পিস্তল, গুলি ও ম্যাগজিন লাশের সাথেই ছিল।

গত ৩১ মার্চ চর হোগলা কেন্দ্রে উপজেলা নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করে সোনারগাঁয়ে ফেরার পথে মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবিতে মারা যান টিএসআই সেলিম, প্রিজাইডিং অফিসার বোরহান উদ্দিন এবং আনসার সদস্য রীতা আক্তার। তিনজনেরই লাশ বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়।

কলাগাছিয়া নৌফাঁড়ির দায়িত্বরত পুলিশ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মৃত্যুর সময়ও দায়িত্ব পালন করে গেছেন টিএসআই সেলিম। পুলিশের অস্ত্র খোয়া গেলে সমস্যা হয়। ট্রলারডুবির সময় সেলিম চাইলে অস্ত্র ফেলে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ছাড়েননি। সরকারি কোনো আমানত তিনি হারাননি। লাশ উদ্ধারের সময় সরকারের দেয়া পিস্তল ছিল, গুলি ছিল, ম্যাগজিনও ছিল।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি নিহত সেলিম মিয়া। তিনি গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুর এলাকার ইয়ার আলী শেখের ছেলে।

জেলা ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) তাসলিম হোসেন জানান, একজন ভালো মানুষ ছিলেন টিএসআই সেলিম মিয়া। শহরের চাষাড়া দায়িত্ব পালন করতেন ট্রাফিক পুলিশের। লাশ উদ্ধারের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন জেলা পুলিশের অনেক সদস্য। গোপালগঞ্জ জেলার গোপিনাথপুর জেলার নিজ বাড়ির পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয় তাকে।

সংসারের বড় ছেলে বোরহান উদ্দিন ইসিবি ব্যাংক সোনারগাঁও উপজেলার মেঘনাঘাট শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন। ৩১ মার্চ সোনারগাওয়ের চর হোগলা কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। কে জানতো এ নির্বাচনই তার জীবনের শেষ নির্বাচন। আর কখনো দায়িত্ব পালন করবে না বোরহান উদ্দিন। মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে চরকিশোরগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ এলাকার মেঘনা নদীর মোহনা থেকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বোরহান উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করে নৌবাহিনীর ডুবুরি দল।

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের মিজানুর রহমানের পুত্র বোরহান উদ্দিন সংসারের সবার বড়। তাদের চার ভাই, এক বোনের সংসারে বোরহান উদ্দিন ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। বোরহানের পরিবারে চলছে শোকের মাতম।

নিহত বোরহান উদ্দিনের ভাই ফরহাদ মিয়া বুধবার রাতে  জানান, ভোটই আমার ভাইয়ের প্রাণ কেড়ে নিলো। এমন সময় কারোর জীবনে যেন না আসে। বড়ভাইয়ের (বোরহান উদ্দিন) রোজগার দিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমার দুই ভাই পড়াশুনা করে। ভাইকে অকালে হারানো পর আমার বৃদ্ধ বাবা মা এখন মৃত্যুশয্যায়।

জানা গেছে, বোরহান উদ্দিনের আকিফ ও আদিব নামে দুই ছেলে রয়েছে। আকিফ এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলে অপেক্ষায় আর আদিব পড়ে ৭ম শ্রেণীতে। ব্যাংক কর্মকর্তা বোরহানের স্ত্রী রেজওয়ানা খাতুন শীলা রাজধানী মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। বাবাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ আকিফ ও আদিব। স্বামী হারিয়ে আকালে বিধবা স্কুল শিক্ষিকা শীলা।

ট্রলারডুবিতে নিহত নারী আনসার সদস্য রীতা আক্তারকে হারিয়ে তার বৃদ্ধা মা রাবেয়া খাতুন পাগলপ্রায়। পরিবারের একমাত্র উপাজর্নকারী রীতার আয় দিয়ে চলতো তাদের সংসার। নরসিংদী জেলার মনহরদী উপজেলার বড়ছাপা ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের মৃত আব্দুল হাশিমের বড় মেয়ে রীতা। প্রায় ১০ বছর আগে স্বামী-সংসার ছেড়ে চলে এসে আনসারে যোগ দেন তিনি। তারা দুই ভাই, তিন বোন। মেঘনার মোহনা চরহোগলার কাছে ইসমানিরচর এলাকা থেকে সোমবার সকালে রিতা আক্তারের (৩৫) লাশ তারা উদ্ধার করা হয়।

নিহত রীতার বোনের ছেলে সজিব মিয়া বৃহস্পতিবার বিকেলে  জানান, বড় খালাকে (রীতা আক্তার) হারিয়ে নানী এখন মৃত্যুশয্যায়। তার আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। অকালে আমার খালা চলে গেলেন ভোট নিতে গিয়ে।

রীতার মামতো ভাই মোশাররফ হোসেন   জানান, নির্বাচনের আগে রাতে তার সাথে আমার কথা হয় ভোটের সময় কোনো গ্যাঞ্জামে না যায় তা বলে দেই। কিন্ত বোন আমার লাশ হয়ে এলো। আমারা মানতে পারছি না। সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর চেঙ্গাইন তার চাচার বাসায় থাকতো রীতা।

আনসার ও ভিডিপি নারায়ণগঞ্জ জেলা কমান্ড্যাট মকসুদ রসুল বৃহস্পতিবার  জানান, নিহত আনসার সদস্য সরকারী বিধি মোতাবেক সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন। দাফনের সময় আমরা ৩০ টাকা দিয়েছি। তার পরিবারে প্রতি সমবেদনা জানাই। দায়িত্ব পালনাকালে রীতার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের সাথে আমারাও শোকাহত।

গত ৩১ মার্চ রোববার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার চরকিশোরগঞ্জের চরহোগলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্ট, পুলিশ ও আনসার সদস্যসহ ১৯ জনের একটি দল ট্রলারে চড়ে বৈদ্যেরবাজার ঘাটের উদ্দেশে রওনা দেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রবল ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি মেঘনা নদীর চরহোগলা এলাকায় উল্টে যায়। এ সময় ১৬ জন তীরে উঠতে সক্ষম হলেও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, একজন পুলিশ কর্মকর্তা ও একজন আনসার সদস্য নিখোঁজ ছিলেন। ঘটনার পরপর তাদের উদ্ধারে অভিযান চালায় ডুবুরিরা। পরে তিনজনের লাশ বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়।

ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বিপিএম ও পিপিএম বার ২ এপ্রিল সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আহত পুলিশ সদস্য ও নারী পুরুষদের দেখতে এসে বলেন, আপনারা দেশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত হয়েছেন। এজন্য সরকার আপনাদের চিকিৎসার সকল ব্যয়ভার বহন করবে। যতদিন না আপনারা সুস্থ হন ততদিন পর্যন্ত আপনাদের চিকিৎসার সমস্ত খরচ সরকার বহন করবে। নিহতের জন্য সমবেদনা। তাদের বিধি মোতাবেক ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

এর আগে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালউদ্দিন বলেছেন, ট্রলার ডুবে নিহত প্রতি পরিবারকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এবং ট্রলার ডুবে যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।

নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ জানান, ট্রলারডুবিতে নিখোঁজ তিনব্যক্তির সবারই লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top