পেঁয়াজের ঝাঁজে অস্থির ক্রেতা, নতুন করে বেড়েছে ডিম-মুরগির দাম

সবজির দাম আগে থেকেই বাড়তি। বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে আদা, রসুনসহ বেশির ভাগ মসলা। বাড়তে শুরু করেছে চালের দামও। এসবের মধ্যেই পেঁয়াজের ঝাঁজে অস্থির হয়ে উঠেছেন ক্রেতারা। কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। বিক্রি শুরু করা হয়েছে খোলাবাজারে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাম কমবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সব হুমকি-ঘোষণা উপেক্ষা করে পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলেছে। নতুন করে দাম বেড়েছে ডিম-মুরগির। গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

খিলগাঁওর ইব্রাহিম জেনারেল স্টোরের মালিক আবুল হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বাজারের কোনো তাল বুঝতে পারছি না। সরকার যা বলে তার সাথে বাজারের মিল নেই। পচনশীল পণ্য হওয়ায় পেঁয়াজ ধরে রাখারও সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে বিক্রি করাই বন্ধ করে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ বিক্রি করব না। তবে এ কারণে স্থায়ী কাস্টমাররা অনেকে ফিরে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। বাধ্য হলে নিজের লোক দিয়ে পরিচিত কাস্টমারদের অন্য দোকান থেকে পেঁয়াজ এনে দিচ্ছেন তিনি। বাজারে এখন দেশী পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, আগের শুক্রবার বিভিন্ন বাজারে যে পেঁয়াজের কেজি ৫৫ টাকা ছিল, গত রোববার তা এক লাফে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা হয়ে যায়। একই দাম গতকালও অব্যাহত ছিল। পাইকারি বাজারে গতকাল দেশী পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ এবং আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৬ থেকে ৬০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়। কয়েক দিন ধরে স্বল্প পরিসরে রাজধানীর খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত রাখে টিসিবি।

রাজধানীর পাঁচটি স্পটে চলছে এ কার্যক্রম। এখানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি পেঁয়াজ কিনতে পারছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সামান্য এ পেঁয়াজ দামের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না।

এ দিকে মুরগি ও ডিমের দাম নতুন করে বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গত সপ্তাহে বাজারে যে মুরগি বিক্রি হয় ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা কেজিদরে, গতকাল শুক্রবার সেগুলো বিক্রি হয় ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। খুচরা বাজারে পাকিস্তানি কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকা কেজি। আর লাল লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায়। বিক্রি এখনো না বাড়লেও বাজারভেদে গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৫৭০ টাকায় এবং খাসির গোশত বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজিদরে। ডিমের দাম কিছু দিন কিছুটা কম থাকলেও আবার বেড়েছে।

গত সপ্তাহে যে ডিমের ডজন ১০০ থেকে ১০৫ টাকা বিক্রি হয়েছে, সপ্তাহের ব্যবধানে সে ডিম গতকাল বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। আর প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়।

রাজধানীর খুচরা বাজারে বর্তমানে এক কেজি থেকে এক কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা কেজিদরে। আর পিস বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরে। পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে। বাজার ও মানভেদে প্রতি কেজি তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছ বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। রুই ও কাতল মাছ বিক্রি হয় ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি। এ ছাড়া পাবদা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ট্যাংরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, শিং ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। স্বস্তি দিচ্ছে না ছোট মাছও। কাঁচকি মাছ বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজিদরে। কয়েক মাস ধরেই এমন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের মাছ।

ঢাকার বাজারে গতকাল শুক্রবার ছোট আকারের প্রতিটি লাউ বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে। এ ছাড়া পাকা টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। গাজর বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা কেজি। করলা বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। বেগুন, পটোল, ঝিঙা, ধুন্দল, চিচিংগা, কাঁকরোল, ঢেঁড়স, বরবটি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। বেগুন, চিচিংগা, ঝিঙা, ধুন্দল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কাঁকরোল ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। শিম বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। ছোট আকারের প্রতি পিস ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। একই দামে বিক্রি হচ্ছে বাঁধাকপি। মুলা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। ধনে পাতার কেজি ৩০০ টাকা। কলার হালি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়।

এ দিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম হঠাৎ করে অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দাম নিয়ন্ত্রণে করণীয় ঠিক করতে সরকারি বিভিন্ন দফতর, পেঁয়াজের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সাথে গত মঙ্গলবার বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকের পর নতুন বাণিজ্য সচিব ড. মো: জাফর উদ্দিন এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আবু রায়হান আল বিরুনি ঘোষণা দেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসা এবং খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করা হলেও রাজধানীর বাজারগুলোতে কমেনি পেঁয়াজের দাম।

এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত সরকার সেদেশ থেকে পেঁয়াজ রফতানির ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দর তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। পেঁয়াজের সর্বনিম্ন রফতানিমূল্য ৮৫২ ডলার নির্ধারণ করে দেয় ভারতের কাঁচা পণ্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ন্যাপিড। দেশটির বাজারে দাম বাড়ায় বাংলাদেশে পেঁয়াজের রফতানি নিরুৎসাহিত করতে ভারত এ কাজ করেছে বলে জানান এ খাত সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে দেশে পেঁয়াজের দাম আরো বেড়ে যায়। হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকেরা জানিয়েছেন, আগে টনপ্রতি পেঁয়াজ ২৫০ থেকে ৩০০ মার্কিন ডলার মূল্যে আমদানি হলেও বর্তমানে তা বাড়িয়ে ৮৫২ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্ধিত মূল্যসংক্রান্ত নির্দেশনা এরই মধ্যে ভারতীয় রফতানিকারকদের পাশাপাশি হিলি কাস্টমসে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকেই নতুন দামে পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে বলে জানান হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারকেরা।

ভারতীয় সূত্র জানায়, ভারতের যেসব এলাকায় অনেক বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়, এরকম বেশ কিছু এলাকা এবার বন্যা হয়েছে। এতে পেঁয়াজের ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এ কারণে সরবরাহ কমেছে এবং আমাদের বাজারেই পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কলকাতার বাজারেই বর্তমানে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় পেঁয়াজ রফতানিকে নিরুৎসাহিত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রুখতে এর ন্যূনতম রফতানিমূল্য ৮৫২ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দিয়েছে ন্যাপিড।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top