নতুন ‘সড়ক পরিবহন আইন’ এর অপব্যবহার হবে নাতো?

কোনো দেশের সরকার যখন নতুন কোন আইন জারি করে তখন সেই আইনটি ক্ষমতাসীন সরকার তার সুবিধের জন্যই করে থাকে। সাধারণ জনগণ এই আইন দ্ধারা কতোটুকু উপকৃত হবে তা আইনটি কার্যকরের পর বুঝা যায়। কিন্তু সরকার নতুন আইনটি পাসের আগে তার পরামর্শকদের নিয়ে আইনটি সরকারের জন্য কতোটুকু সুবিধাজনক তা শতভাগ নির্ণয় করেই আইনটি পাস করেন। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণকারী তথ্য প্রযুক্তি আইনসহ যে কয়টি আইন চালু রয়েছে তা মূলত সরকারের জন্যই লাভজনক। সাধারণ পাবলিক মনে হয়না এসব আইনের দ্বারা কখনও উপকৃত হয়েছেন। তাহলে সরকার কেন জনগণের উপর কঠিন কঠিন আইন চাপিয়ে দিচ্ছে? সেসব একটু ভাবনার বিষয়।

সরকার আদালতের নির্দেশে ১৯৮৩ সালে সামরিক সরকারের আমলে জারি করা ‘দ্য মোটর ভেহিক্যাল অর্ডিন্যান্স’টি (মোটরযান অধ্যাদেশ) নতুন করে পরিবর্তন করে ‘সড়ক পরিবহন আইন’ নামে পাস করে। আমরা সকলেই আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আদালত মূলত যেসব বিষয় বিবেচনা করে নতুন আইন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয় তা সবারই জানা আছে। এইতো বছরখানেক হলো যখন রাজপথে মিলতো বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের লাশ। গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হবার পরে বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। আর তখন আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীদের সেসব কর্মসূচীতে শিক্ষার্থীদের হাতে সরকারের বড় নীতিনির্ধারকরাও ধরা পড়েছেন। শিক্ষার্থীদের হাত থেকে বাদ যায়নি আমাদের সম্মানীত পুলিশ বাহিনীও। বাদ যায়নি সেনাবাহিনীও। আর পাশাপাশি মন্ত্রী, এমপি, সাংবাদিক, আইনজীবিরাতো আছেই। তারা সকলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাস্তায় বেপরোয়া হয়ে ১৯৮৩ সনের আইন অমান্য করে রাস্তা কাঁপিয়ে চলতো। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ভিডিও আজও আনাগোনা করে। সেজন্য অবশ্য দেশের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এখনও মন থেকে স্যালুট দেই। যাই হোক, আমরা তো তখন দেখেছি এদেশে সবচেয়ে বেশি আইন কারা ভঙ্গ করে। আমরা এও দেখেছি, সরকার দলীয় প্রভাবশালীর সন্তানকে সাধারণ মানুষের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে। এইতো গত বছরের ১৯ জুন নোয়াখালীর এক সংসদ সদস্যের বেপরোয়া ছেলের গাড়ির চাপায় রাজধানীতে সেলিম ব্যাপারী নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। এগুলো ভুলে যাওয়াই ভালো! দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা সহজেই দেশ ছেড়ে পালাতে পারলে এসব ছোটখাটো অপরাধ করে ক্ষমতাসীনরাতো ফাঁসিকাস্টে ঝুলবেনা? ঘটনা শেষ হতে না চাইলেও বিচার প্রক্রিয়া যেন শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ, অপরাধ করেছে, বিচার হয়েছে। কি বিচার হয়েছে তা দেখার বিষয় নয়। সুতরাং, আইন সবার জন্য সমান হলেও বিবেক সবার জন্য সমান নয়! আমাদের বিচার বুদ্ধিতে যথেষ্ট দাগ পড়েছে। তা শোধরে ওঠা বড়ই কষ্টের। তাই এসব নতুন নতুন আইন সাধারণ জনগণের উপর বর্তানো সরকারের মূল লক্ষ থাকে। আর সেজন্যই সরকারের পরামর্শকরা নিজের ক্ষমতা বলে পার পেয়ে গেলেও আটকে দিচ্ছে সাধারণ জনণকে।

বাংলাদেশে এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, মন্ত্রীর নির্দেশে ধর্মঘট, মন্ত্রীর নির্দেশেই প্রত্যাহার! আশ্চর্যজনক হলে সত্য। কারণ, শ্রমিক নেতা মন্ত্রীর লোকদেরকে কেন আদালত ফাঁসি কাস্টে ঝুলিয়ে মারতে আদেশ দিলো! ২০১১ সালে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর নিহত হলে এক মামলায় গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি জামির হোসেন নামের এক পরিবহন শ্রমিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত৷ এছাড়া সাভারে এক নারীকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগে গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মীর হোসেন মীরু নামে আরেক চালককে ফাঁসির আদেশ দেন সিএমএম আদালত। দেশের আদালত যখন বেশ কয়েকটি সড়ক দূর্ঘটনার আলোকে পরিবহণ শ্রমিকদের দন্ডাদেশ দেন ঠিক তখনি দেশের যোগযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন তৎকালীন নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খান। কারণ, তিনি মন্ত্রীত্বের পাশাপাশি স্বাদ নিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি হয়েও। তিনি নৌকা মন্ত্রী হলেও সড়ক পথে রয়েছে তার সড়ক মন্ত্রীর চেয়ে বহুগুন ক্ষমতা। যাইহোক, আমাদের বুঝার বাকি নেই যে, সরকারই ক্ষমতা, ক্ষমতাই সরকার।

এদিকে, শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়েছে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন। এই আইনে সড়কে নিয়ম ভঙ্গে জরিমানা বেড়েছে দশ থেকে হাজার গুণ। ফলে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন বাড়ছেইতো বাড়ছে। কমছে না। সরকার এত কঠিন একটা আইন করে জণগণকে কোন সফলতার গল্প শোনাতে চাইছে তা বোধগম্য নয়। তবে এটা নিশ্চিত যে, ক্ষমতাসীনদের জন্য এই আইন আশীর্বাদস্বরূপ। যেমন সফলতা ভোগ করছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন। আজকাল মোটর সাইকেলের সামনে পেছনেও “সংগঠনের” নাম ব্যবহার করে স্টিকার লাগিয়ে রাজপথ হাকাচ্ছে। অনেক ক্ষমতাসীন নেতা তাদের নামের আগে সংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করতে ভালবাসেন, সেই সাথে মোটরযানেও সংগঠনের একটা স্টিকার লাগাতে ভুলেন না। তারা এটা নিশ্চিত যে, ক্ষমতাসীন সংগঠনের নাম ব্যবহার করলে ৫০ হাত দূর থেকেই বেঁচে থাকা সম্ভব। যে যাই করুন, সাধারণ জনগণকে কিন্তু তার নিজস্ব গতিতেই এগুতে হবে।

আমাদের চারপাশে যেসব ঘটনা প্রতিনিয়ত দেখছি, সেসব ঘটনার প্রত্যেকটির সাথে ক্ষমতাসীনরা জড়িত রয়েছে। যা সংবাদ মাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়। কিছু ঘটনা যখন একদম ধামাচাপা দেয়া যায়না ঠিক তখন একটা ব্যবস্থা নিতে হয় সরকারকে। যেমনটা করতে হয়েছে বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যায় জড়িত অমিত সাহার ক্ষেত্রে। একদিকে সরকার অপরাধীদের বিচারের আশ্বাস দিচ্ছে, অপরদিকে জাতিসংঘ নিন্দা জানানোয়-ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির কাছে নিন্দার ব্যাখ্যাও চেয়েছে সরকার। তার মানে কি ? দলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মকান্ডে জাতিসংঘ নিন্দা জানানোয় সরকার যদি ব্যাখ্যা চাইতে পারে তবে বিশ্বজিৎ হত্যাকারীরা উচ্চ আদালত থেকে রেহাই পেয়েছে, আবরার হত্যাকারীরা নিজেরাও এমন আশা করলে ভুল হবে না। যাইহোক, বেঁচে থাকার আরেক নাম ক্ষমতা এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন দ্বারা কে বা কারা উপকৃত হবেন তা এখন একটু চিন্তা করি।

ঢাকাসহ সারা দেশে এনা পরিবহনের একটু প্রভাব আলাদা আছেই। এনা পরিবহনে কর্মরত কর্মচারীদের প্রভাবও একটু বেশি লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ কারণ কি? এটা সবাই একটু খোঁজ নিয়ে জানবেন। এমন করে দেশের সড়ক পরিবহণে কে কিভাবে প্রভাব বিরাজ করে তা লক্ষ্য করবেন। তাহলেই পেয়ে যাবেন বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন কার জন্য সে উত্তরটা।

দেখুন, বাংলাদেশের পুলিশ সুনামের পাশাপাশি দুর্নামও বহন করছে। যেমনটা অনেক নিউজ পেপারে দেখা যায় যে, সাধারণ মানুষের পকেটে ইয়াবা, গাঁজা ঢুকিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করা। তেমনি করে, এই সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হওয়ায় আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যরা অতিরিক্ত সুবিধা নিবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন, আপনাকে সিগন্যাল দিলো থামার জন্য। আপনি থামলেন। কিন্তু তাকে সালাম দিলেন না। এতে বেচারা যদি আপনার প্রতি ক্ষিপ্ত হয় তবে আপনি হেলমেট না রাখার মামলায় পড়তে পারেন। আপনার মাথায় হেলমেট থাকলেও ওই যে ইয়াবার মতো ফেঁসে যেতে পারেন ১০ হাজার টাকা জরিমানায়! শুধু তাই নয়, সিটবেল্ট না বাঁধলে আগে জরিমানা ছিল ২০০ টাকা। এখন তা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে সর্বোচ্চ সাজা ছিল ২০০ টাকা। নতুন আইনে এ অপরাধে সর্বোচ্চ জরিমানা রাখা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। অতিরিক্ত ওজন বহন করে মোটরযান চালালে এক বৎসরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন, না হয় একলক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। বিস্ফোরক বা দাহ্য পদার্থ মোটরযানে রাখলে সেজন্য আপনাকে ৩ মাসের কারাদন্ড বা অনধিক ২৫ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে হবে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। মনে রাখা ভালো যে, মোটরসাইকেলে যে পেট্রোল ব্যবহার করেন তাও কিন্তু দাহ্য পদার্থ। পুলিশ যদি মনে করে আপনি আপনার মোটর সাইকেলের ট্যাংক ভরে অন্যত্র দাহ্য পদার্থের অপব্যবহার করবেন তাহলে কিন্তু রেহাই পাবেন না! নিয়ন্ত্রনহীনভাবে মোটরযান চালানোর কারনে দুর্ঘটনায় কারো জীবন বা সম্পত্তির ক্ষতি হলে আপনাকে তিন বৎসর কারদন্ড ভোগ করতে হবে বা ৩ লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। সেজন্য পুলিশ অবশ্য তার জবাবদিহী নিশ্চিতের জন্য জরিমানা বা আইন প্রয়োগের সময় চালকসহ উপস্থিত জনতার একটা ভিডিও ফুটেজ রাখতে পারে। তবে কিছু আইন দেখে মনে হয়, দেশের লাখপতিদের জন্যই আইনগুলো সময়পোযোগী। সেই সাথে পুলিশ ভাইদের সুদিন যেন আবারো ফিরে আসছে।

লেখক : মো. আব্দুল কাইয়ুম-সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

Share this post

scroll to top