জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন আসাদুজ্জামান রানা। ২০১৩ সালে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। থাকতেন উত্তর মুগদা এলাকায় বড় বোনের বাসায়। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন তিনি। আদরের ছোট ভাইকে হারিয়ে শোকে পাথর পুরো পরিবার। কিন্তু কোনো এক অজানা আতঙ্কে আজ কোনো কথাই বলতে চান না তারা। ভাই নিখোঁজের বিষয়ে কোনো তথ্যও আর জানাতে চান না কাউকে। নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে রানার বোন মিনারা বেগমের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রানার বিষয়ে মিডিয়ার সাথে কোনো কথাই বলতে অস্বীকৃতি জানান। বলেন, ভাই গুম হয়েছে ছয় বছর আগে, এখন আমরা গুম হতে চাই না।
গত কয়েক দিন নয়া দিগন্ত অনুসন্ধান করে আসাদুজ্জামান রানার গুমের বিষয়ে কিছু কাগজপত্র হাতে পেয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, বোন মিনারা বেগম তার ভাইয়ের খোঁজ পেতে প্রশাসনের সহায়তা চেয়ে হাতে লেখা চিঠি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। থানায় জিডি করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। কিন্তু এখন আর কিছুই করতে চান না তারা। প্রথমে মুগদা থেকে অন্যত্র বাসা নিয়েছেন থেকেছেন কিছ ুদিন। এরপর কী এক অজানা আতঙ্কে গত বছর শহর ছেড়ে সোজা চলে গেছেন রংপুরের বদরগঞ্জে। দীর্ঘ ছয় বছরেও গুম হওয়া ভাইয়ের কোনো সন্ধান না পেয়ে তারা এখন সেই আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
মাজহারুল ইসলাম রাসেল গুম হন ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর রাত ২টায়। পরিবারের সাথে থাকতেন রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার পশ্চিম নাখালপাড়ায়। প্রথম দু-তিন বছর বিভিন্ন দফতরে দৌড়াদৌড়ি করার পর এখন রাসেলের বাবা আমিনুল হক আর কোনো চেষ্টা সাধনাই করছেন না। আমিনুল হক পেশায় ঠিকাদার। ছেলের শোকে তিনি ব্যবসাও বাদ দিয়েছেন। নগরীর আয়েসি জীবন ছেড়ে চলে গেছেন আদি নিবাস শেরপুরের নকলায়। নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও জানান তার অনাগ্রহের কথা। বললেন, কী আর হবে? অনেক চেষ্টা সাধনাইতো করেছি। দীর্ঘ দিন এখানে-সেখানে ঘুরেছি। যার কাছে যে আশ্বাস পেয়েছি তার পেছনেই ছুটেছি। কোনো ফল পাইনি। এখন সব কিছুকে ভাগ্যের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছি। ঢাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি শেরপুরে।
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের খালিদ হোসেন সোহেল। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর তারই এক নিকট-আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছেন নাজিম উদ্দিন রোডের (সেই সময়ের) কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখান থেকেই সোহেলসহ আরো কয়েকজন নিখোঁজ হন। অদ্যাবধি আর কোনো খোঁজ মেলেনি তাদের। সোহেলের স্ত্রী সৈয়দা তান্নী সুলতানার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান নানা আতঙ্কের কথা। দীর্ঘ দিনের পৈতৃক নিবাস জয়চন্দ্র ঘোষ লেনের ওই বাসায় পরিবর্তন করেছেন। এখন থাকেন ভাড়া বাসায়। তবে বাসা বদলানোর কারণ জানতে চাইলে সোহেলের স্ত্রী অবশ্য আগের বাসা সংস্কারের কারণকেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর বাইরেও অজানা হয়তো কোনো কারণ রয়েছে।
ঢাকারই কোনো এক মালিকের প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভারের চাকরি করতেন কাওসার। বাসা ছিল তেজগাঁও পশ্চিম নাখালপাড়ায়। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর রাত ২টায় তাকেও তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কাওসারের স্ত্রী সেই সময় থেকে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে একমাত্র মেয়ে সাত বছরের লামিয়া আক্তার মীমকে নিয়ে ঢাকায়ই মাটি কামড়ে আছেন। গ্রামের বাড়ি বরিশাল। মা-মেয়ের পরিবারটিও এখন শুধু দুঃখ নয়, অজানা কোনো এক আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। অজানা ভয়ে এরই মধ্যে বাসাও পরিবর্তন করেছেন। স্বামীর খোঁজ করার মতো এখানে-সেখানে যাওয়ার মতোও কোনো অর্থ তাদের নেই। মেয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাতে মিনু আক্তার এখন বাসায়ই আরবি প্রাইভেট পড়ান। স্বামী আর বাবার অপেক্ষায় এভাবেই হয়তো কেটে যাবে নিখোঁজ কাওসারের স্ত্রী আর সন্তানের বাকি জীবন।
গুম বা নিখোঁজ কিংবা মানবাধিকারের এই সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে শুরু থেকেই জনগণের মতামত তুলে ধরছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)। তারা সময়ে সময়ে দেশের নাজুক পরিস্থিতি গবেষণার ভিত্তিতে সরকারের সামনে তুলে আনেন। কিন্তু দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিস কেন্দ্রের এমন পর্যবেক্ষণ মানতে রাজি নয় সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কিংবা রহস্যজনক গুম বা নিখোঁজের ঘটনাসহ মানবাধিকার নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই বলেই মনে করে সরকার।
এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, পরিস্থিতির অবনতির কোনো প্রশ্ন ওঠে না বরং সারা দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে বলা যায়, আগের বছরগুলোর তুলনায় এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যা-ই বলা হোক আইন ও সালিস কেন্দ্র বলছে গুম, গুপ্ত হত্যা কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক তদন্ত করা উচিত। পাশাপাশি মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের আরো কার্যকর ভূমিকাও প্রত্যাশা করেছেন তারা।