মিসরের পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনের এমন একটি প্যাকেজ অনুমোদন করেছে, যার মাধ্যমে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ২০৩৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। এ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরো বৃদ্ধি পাবে।
মিসরের পার্লামেন্টের ৫৯৬ জন সদস্যের ৪৮৫ জনই এ সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেন। এটি এখন গণভোটে যাবে। সেখানে সংশোধনীটি বিজয়ী হলে সিসি এখন থেকে আরো ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার অধিকার লাভ করবেন, যিনি ইতোমধ্যেই ৫ বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাধারণভাবে সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করা হয়। কিন্তু বিশেষভাবে শুধুমাত্র সিসির জন্য এ ছয় বছরের মেয়াদ আরো দুইবারের জন্য অনুমোদন করা হয়। এটি বাস্তবায়িত্ব হলে সিসির ক্ষমতার মেয়াদ তিন দশকে গিয়ে ঠেকবে।
এখন পার্লামেন্ট ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সিসিকে যে সমর্থন দিয়েছে ও দিচ্ছে, তা পূর্ণ হলে ২০২২ সালে সিসির দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হলে আরো ১২ বছরের জন্য তাকে ক্ষমতা প্রদান করা হবে।
এই সংশোধনীতে দেশটির বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা এবং আইন প্রণয়নের আগে তার খসড়ায় বিচার বিভাগের নজরদারির বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া এতে দেশটির সেনাবাহিনীকে মিসর রাষ্ট্রের, গণতন্ত্রের এবং সংবিধানের অভিভাবক ও রক্ষক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে তিন দফা আলোচনার পর বৃহস্পতিবার এ ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেক্ষেত্রে আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি বা সামরিক বাহিনীর ভূমিকার বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে খুব কমই।
পার্লামেন্টের স্পিকার আলি আবদুল-আল জানান, এখন এ বিষয়টি ৬০ দিন ধরে আলোচনা-পর্যালোচনা করবে সাংবিধান ও আইন বিষয়ক কমিটি। এরপর চূড়ান্ত ভোটের জন্য এটি আবার পার্লামেন্টে আসবে। তারপর বিষয়টি দেয়া হবে গণভোটে। সব মিলিয়ে রমযানের শুরুর দিকে মে মাসের মধ্যেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
পার্লামেন্টে এটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হলেও পার্লামেন্টের বাইরে এটি ব্যাপক সমালোচনা মুখে পড়েছে। রাজনীতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও বর্তমান সংবিধানপ্রণেতারা এ ব্যাপারে একটি গণস্বাক্ষরের আয়োজন করেছেন। তারা এ বিষয়টিকে সিসির ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা হিসেবে আখ্যা দেন।
বিরোধীরা বলেন, সংবিধান সংশোধনের এ চেষ্টাটিই সংবিধানের লঙ্ঘন। বর্তমান সংবিধান অনুসারে কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। কিন্তু এই সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে পূর্ণ ক্ষমতাকে নিজের হাতে নিতে এবং বিচার বিভাগের নির্বাহী কর্তৃত্বকে আয়ত্তে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। এর ফলে ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ কোনো উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার পথে মিসরের অগ্রগতির পথে বাধার সৃষ্টি করবে।
সমালোচকরা বলছেন, এর মাধ্যমে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার ৮ বছর পর আবারো সেই স্বৈরতন্ত্রের দিকে ফিরে যাচ্ছে। হোসনি মোবারকের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেশটিতে গণতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু এক বছর পরই এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন সেনাপ্রধান সিসি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এই সংশোধনী বিচারবিভাগের স্বাধীনতাকে আরো খর্ব করবে এবং দেশে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করবে, ইতোমধ্যেই মিসরে যার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। হিউম্যান রাইট ওয়াচ বলছে, ১৫ হাজার বেসামরিক নাগরিক সামরিক বাহিনীর অভিযানে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে।
এছাড়া বিরোধী দলীয় লাখ লাখ রাজনীতিবিদকে বিতর্কিত ও দমনমূলক এক আইনের অধীনে বন্দি রাখা হয়েছে। সিসির সরকার অবশ্য সব সময়ই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো সিসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আরোহন করেন। গত বছর তিনি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। তবে বিরোধী দলীয় নেতারা বিভিন্ন অভিযোগে কারাগারে অথবা নির্বাসনে থাকায় এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। সিসি ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধীদল, ভিন্ন মতাবলম্বী, নাগরিদের বাক স্বাধীনতা ইত্যাদির ওপর বেশ খড়গহস্ত।
সূত্র : ডেইলি সাবাহ