প্রাপ্তির উপচে পড়া ভান্ডারেও অপ্রাপ্তির হাহাকার তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়৷ সাফল্যের পুষ্পবৃষ্টিতে ভেসে যাবার সময়ও সমালোচনার কাঁটার ক্ষত ভোলেন না৷ সে কারণেই তামিম অনন্য৷ আরো বড় অর্জনের হাতছানিতে চন্দ্রাহতের মতো ছুটে চলেন তিনি৷
নিউজিল্যান্ড সফর দিয়েই শুরু করি৷ সে দেশে আপনার টেস্ট অভিষেক, যেখানে দুই ইনিংসেই করেন ফিফটি৷ নিউজিল্যান্ড আপনার জন্য তাই কতটা স্পেশাল?
তামিম ইকবাল : ওদিক থেকে চিন্তা করলে অবশ্যই স্পেশাল৷ কিন্তু সামগ্রিক অর্থে নিউজিল্যান্ড সফর নিয়ে বললে, ওই দেশে গিয়ে আমরা এখনো কোনো ম্যাচ জিততে পারিনি৷ যদিও সর্বশেষ সফরে বেশ কয়েকবার জেতার কাছাকাছি গিয়েছিলাম৷ তেমন অবস্থায় গেলে এবার যেন ম্যাচ জিততে পারি, সে লক্ষ্য থাকবে৷ জিতলে তা আমাদের জন্য বড় অর্জন হবে৷
অভিষেক টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ইনিংসে খেলেন ৫৩ ও ৮৪ রানের ইনিংস৷ সেঞ্চুরি মিস করায় খারাপ লাগেনি?
অবশ্যই৷ এখনো মনে পড়ে, দ্বিতীয় ইনিংসে আউট হবার বলটি নীচু হয়েছিল; বোল্ড হয়েছিলাম৷ নিউজিল্যান্ডে বল নীচু হবার আশা কেউ করে না৷ আমার দুর্ভাগ্য যে, ঠিক তাই হয়ে যায়৷ টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরির মতো বড় মাইলফলক স্পর্শ করতে কে না চায়! অমন কিছু হলে তা বাকি জীবন মনে থাকে৷ তারপরও প্রথম টেস্টে কিছু হলেও তো করতে পেরেছি৷ দুই ইনিংসে ফিফটি করেছি৷ জুনায়েদ সিদ্দিকীর সঙ্গে ১৪০ রানের মতো জুটি হয়েছে (আসলে ১৬১ রানের)৷ সবচেয়ে বেশি আনন্দের এই যে, দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ব্যাটিং করতে নামি, সেদিন ৪৩ ওভারের খেলা বাকি৷ আমরা দুজনই অপরাজিত থেকে দিন শেষ করি৷ নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে এমনটা করতে পারা খুব স্পেশাল৷ পরে হয়তো ৫০, ৬০ ওভার ব্যাটিংও করেছি৷ তবে ওই সময়ে সেটি ছিল বড় অর্জন৷
গত নিউজিল্যান্ড সফরে যাবার ঠিক আগের টেস্টে বাংলাদেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অসাধারণ সেঞ্চুরি করেছিলেন৷ এরপর ১২ টেস্ট খেললেও আর কোনো সেঞ্চুরি নেই আপনার৷ মাথায় আছে?
আমার মাথায় সব কিছুই থাকে৷ সেঞ্চুরির কাছাকাছি গিয়েছিলাম কোনো ইনিংসে?
অনেকগুলোতে৷ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আশির ঘরে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক টেস্টের দুই ইনিংসে সত্তরের ঘরে…
সেঞ্চুরির কাছাকাছি গিয়েও সেঞ্চুরি করতে না পারাটা আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায়৷ গত দুই-তিন বছরে ওয়ানডে ফরম্যাটে তা কিছুটা কাটিয়ে উঠছি৷ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরু পাওয়াটা সব সময় কঠিন৷ শুরু পেয়ে গেলে বড় রান করা সহজ৷ আমি সব কঠিন কাজগুলো করি, যে সময় বাকি কাজটুকুন সহজ হয়ে যায়, তখনই কিছু ভুল করি আর সেঞ্চুরি করার সুযোগ কাজে লাগাতে পারি না৷
বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে…
হ্যাঁ, বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে৷ আর এ সময়ে ১২টি টেস্টের মধ্যে আটটি টেস্ট আমি দেশে খেলেছি, বাকি চারটি বিদেশে (আসলে এ সময়ে চারটি টেস্ট দেশে খেলেছেন, বাকি আটটি বিদেশে)৷ দেশে এখন এমনই উইকেটে খেলা হয়, যেখানে ৪০-৪৫ রানের ইনিংসই সেঞ্চুরি হিসেবে ধরতে পারেন৷ কারণ, এ ধরনের উইকেটে সেঞ্চুরি করা কঠিন; খুব খুব কঠিন৷ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজটি সরিয়ে রেখে খেয়াল করুন৷ বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রতিক সময়ে খেলা বাকি সিরিজগুলোয় দুই দল থেকেই খুব বেশি সেঞ্চুরিয়ান পাবেন না৷ এ ধরনের উইকেটে ৬০-৭০-৮০ রানের ইনিংসগুলো ১৫০ হিসেবে বিবেচিত হবার মতো, কেননা, সেখানে এমন ডেলিভারি পাবেন, যাতে যে কোনো মুহূর্তে আউট হয়ে যেতে পারেন৷
সেঞ্চুরিখরার এ রেকর্ডটি পরিবর্তনের প্রত্যয় এবারের নিউজিল্যান্ড সফরে থাকবে নিশ্চয়ই? সব ফরম্যাট মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডে যে ১৯ ম্যাচ খেলেছেন, তাতেও তো সেঞ্চুরি নেই৷ সেটি বদলানোর প্রতিজ্ঞাও থাকবে কিনা…
(হতাশ হয়ে) এটি আরেকটি জিনিস৷ আমি নিউজিল্যান্ডে রান করেছি৷ টেস্টে রান করেছি, ওয়ানডেতেও রান করেছি৷ কিন্তু সেঞ্চুরি এমন এক জিনিস, যা করলে স্মৃতি হিসেবে থেকে যায়৷ আশা করি, এটিই সেই সফর, যেখানে সুযোগ পেলে অবশ্যই কাজে লাগানোর চেষ্টা করব৷
খুব ভালো ফর্ম নিয়ে নিউজিল্যান্ড যাচ্ছেন৷ বিশেষত ওয়ানডে ফরম্যাটে৷ গত বছর খেলা ১২ ওয়ানডেতে ৮৫ দশমিক ৫০ গড়ে করেন ৮৯৬ রান; দুটো সেঞ্চুরি, ছয় ফিফটি৷ গত বছর বিশ্ব ক্রিকেটেই কেবল বিরাট কোহলি ও রস টেলরের ওয়ানডে ব্যাটিং গড় আপনার চেয়ে বেশি৷ আত্মবিশ্বাস তাই নিশ্চয়ই অনেক বেশি থাকবে?
আমি আগে কী করেছি, তা নিয়ে একদমই ভাবি না৷ হয়তো এটি আমার এক শক্তির জায়গা৷ গত চার বছরে আমার ক্যারিয়ার-গ্রাফ সব সময়ই উর্ধমুখী৷ কিন্তু এ জিনিসটি মাথায় কখনো আসেনি৷ অমনটা হলে হয়তো কিছুটা আয়েশি হয়ে যাবো৷ আর কোনো ম্যাচে ৭০-৮০ কিংবা সেঞ্চুরি করলেও পরের খেলায় নামার সময় খুব নার্ভাস থাকি৷ ভাবতে থাকি, ব্যর্থ হওয়া চলবে না; রান করতে হবে–এসব৷ রান করাকে আমলে না নেওয়াটা আমার সাম্প্রতিক ভালো ফর্মের হয়তো একটা কারণ৷ সবসময় বিশ্বাস করি, আমার আরো অনেক কিছু অর্জন করার বাকি৷ এত দিন যা করেছি, ভালোই করেছি৷ কিন্তু গর্বিত হওয়ার মতো স্পেশাল কিছু এখনো করিনি৷
ইনজুরি নিয়ে তো গত বছর বেশ ভুগেছেন৷ এখন কী অবস্থা?
ইনজুরি এমন একটা ব্যাপার, যার কিছু-না-কিছু সব খেলোয়াড়েরই থাকে৷ একটা সিরিজের আগে ১০০% ফিট হওয়া প্রায় অসম্ভব৷ এখনো আমার হাঁটুতে খানিকটা ব্যাথা রয়েছে৷ এসব নিয়েই খেলতে হবে৷ নিউজিল্যান্ড সফরেও সেভাবেই খেলব৷
অনেকবার বলেছেন, তারপরও ইনজুরি নিয়েও যে এশিয়া কাপে ওভাবে এক হাতে ব্যাটিংয়ের জন্য নেমে গেলেন, তা নিয়ে যদি আরেকবার বলেন৷ আসলে তখন মাথায় কী খেলা করছিল?
একটি কথা আছে, ‘থার্টি সেকেন্ড অব ম্যাডনেস’৷ প্রতিটি মানুষের জীবনে কোনো-না-কোনো সময় এমন মুহূর্ত আসে, যেখানে সে অন্য কিছু নিয়ে আর ভাবে না৷ আমার কাছে ওই ইনজুরি নিয়ে মাঠে নেমে যাবার ব্যাপারটি ৩০ সেকেন্ডের পাগলামি বলেই মনে হয়েছে৷ আমাকে বলা হয়েছিল, ব্যাটিং করা লাগবে না৷ যদি মুশফিক স্ট্রাইকে থাকে, তাহলেই কেবল ক্রিজে গিয়ে অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকবো৷ কারণ, মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে ইনজুরিতে পড়েছি; তখন দৌড়াদৌড়ি করলেও তা হাড়ের জন্য ক্ষতিকর৷ কিন্তু যখন দেখলাম, ওই ওভারের এক বলই কেবল আছে, তখন দুনিয়ার অন্য কিছু আর চিন্তা করিনি৷ শুধু ভেবেছি– এ বলটি খেলতে পারবো৷ এটি তাই আমার জন্য বলতে পারেন ওই ৩০ সেকেন্ডের পাগলামি৷
‘৩০ সেকেন্ডের পাগালামি’র যে কথা বারবার বলছেন, তা কি অনেকটা প্রেমের মতো? কারণ, এমন পাগলামি তো প্রেমের বেলাতেই সাধারণত দেখা যায়৷ ক্রিকেট নিয়ে আপনার প্রেমের প্রকাশই কি ওই ৩০ সেকেন্ডের পাগলামিতে ব্যাটিং করতে নেমে যাওয়ায়?
হ্যাঁ, দেখুন, লোকজন অনেক কিছু বুঝতে পারে না৷ আমি শুধু নিজের কথা বলছি না, পুরো দলের পক্ষ থেকে বলছি৷ লোকে দেখে, আমি ভালো খেলি কিংবা ভালো খেলি না৷ কিন্তু একজন নিজের খেলা নিয়ে কতোটা আবেগী, কতটা পরিশ্রমী, তা মানুষজন দেখে না৷ কারণ, সবাই তা করে আড়ালে৷ দেশের জন্য ভালোবাসা থাকে হৃদয়ে৷ এটি তো আপনি দেখাতে পারবেন না…
যেকোনো পারফর্মারের বেলাতেই কিন্তু এটি সত্য৷ শিল্পী বলুন, নায়ক বলুন, গায়ক বলুন–সবাই তাদের ওই চেষ্টাটা করে আড়ালেই৷
সত্যি তাই৷ বিষয়গুলো চাইলেও আপনি দেখাতে পারবেন না৷ এশিয়া কাপের ওই সময়টায় ইনজুরি নিয়ে মাঠে নামার সময় মনে হয়েছে, দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই৷ দলের চেয়ে বড় কিছু নেই৷ সেজন্য আমাকে যদি এক বল খেলে আবার ইনজুরিতেও পড়তে হয় তবু তা করতে রাজি৷ সত্যি কথা বলি, আমি তো জানতাম না, ওই এক বল খেললে মুশফিক আরো ৩২ রান করবে৷ আমি না, কেউই তা জানত না, এমনকি মুশফিকও না৷ কিন্তু আমি ভেবেছি, অন্তত চেষ্টা তো করি৷ আমাদের অনেক ক্রিকেটার অনেক সময় এমন কাজ করেছেন৷ কোনো কারণে তা নিয়ে হয়তো খুব হইচই হয়নি৷ মাশরাফি ভাই যেমন হাঁটুতে সাতটি অপারেশন নিয়ে খেলছেন৷ সাকিবও অনেক সময় খেলেছে সেভাবে৷ মুশফিক পাঁজরের ইনজুরি নিয়ে খেলেছে৷ আমি তাই কোনো কিছু প্রমাণ করার জন্য জিনিসটি করিনি৷ দেশের জন্য আমার ভালোবাসা দেখানোর জন্যও করিনি৷ কতটা ভালোবাসি, তা আমার ভেতরেই রয়েছে৷ আমি অমনটা করেছি হৃদয় থেকে৷
এবার একটু বিশ্বকাপ প্রসঙ্গে আসি৷ আপনাদের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেছেন, বাংলাদেশের এই দল বিশ্বকাপ জয়ের সামর্থ্য রাখে৷ আপনিও কি তা বিশ্বাস করেন?
যদি তা বিশ্বাস না করি, তাহলে আমাদের বিশ্বকাপে গিয়ে খেলার কোনো মানে নেই৷ যদি মনে করি, ৯ ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে জিতে ফিরলেই লোকে খুশি থাকবে, তাহলে আমার ক্রিকেট না খেলাই উচিত…
কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে কি বাংলাদেশ অমন শিরোপা জয়ের বিশ্বাস নিয়ে যেতে পেরেছিল?
সেবার আমাদের বিশ্বাস ছিল কোয়ার্টার ফাইনাল খেলব৷
মানে, তখন বাংলাদেশ দলের যে অবস্থা ছিল, সে বিবেচনায়?
হ্যাঁ, এখন আমরা যে কোনো টুর্নামেন্ট খেলতে নামি জয়ের লক্ষ্য নিয়ে৷ যে কোনো ম্যাচ খেলার আগে লক্ষ্য থাকে জয়ের, সে ক্ষমতা আমাদের থাকুক-বা-না থাকুক৷ এখনকার দল ভালো করার সামর্থ্য রাখে৷ চ্যাম্পিয়ন হবো কিনা, সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে আমি পছন্দ করি না৷ শুধু জানি, এই দল এমন স্পেশাল কিছু করার সামর্থ্য রাখে, যেটি আগের কোনো বাংলাদেশ দল করতে পারেনি৷
সেখানে একজন সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে আপনার ভূমিকা কী হবে?
দল যে ভূমিকা দেবে, সেটি যেন ভালোভাবে পূরণ করতে পারি– এটিই হবে আমার ভূমিকা৷ সঙ্গে সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে আমি যেন একজন নেতা হতে পারি৷ নেতা হবার জন্য আপনার অধিনায়ক, সহঅধিনায়ক হতে হবে না৷ এগুলো কেবলই নাম বসিয়ে দেয়া৷ আমি আমার কাজ দিয়েই নেতা হতে পারি৷ পাঁচ-ছয়জন বাদ দিলে আমাদের দলটি তরুণ৷ আমি যেন কাজ দিয়ে ওদের পথ দেখাতে পারি, সে লক্ষ্যই থাকবে৷
গত বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৫ রান করে আউট হয়ে যান৷ আর পাঁচ রান করলেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হতে পারতেন, ঠিক পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যা হয়ে যান মাহমুদ উল্লাহ৷ চার বছর পরও কি সেজন্য একটু আফসোস হয়?
আমি আসলে সেজন্য আফসোস করি না৷ আফসোস করি, সেঞ্চুরি মিস করায়…
দেশের প্রথম সেঞ্চুরি… বিশ্বকাপে?
আমি আসলে বিশ্বকাপে যাবার আগে বলেও গিয়েছিলাম যে, দেশের পক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করতে চাই৷ কিন্তু , ‘ক্রিকেট ইজ আ গ্রেট লেভেলার’, মানুষকে নিজের জায়গাটা মাঝেমধ্যে বুঝিয়ে দেয়৷ আপনি তাই যা চাইবেন, সবসময় তেমনটা হবে না৷ আবার এমন অনেক অর্জন করেছি, যা কখনো ভাবিনি যে আমি করতে পারব৷ অবশ্যই দেশের পক্ষে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি করতে পারলে খুশি হতাম৷ কিন্তু সামনের বিশ্বকাপে তো নতুন সুযোগ, নতুন রেকর্ডের হাতছানি থাকবে৷ গত কয়েক বছরে যেভাবে এগোচ্ছি, তা ধরে রাখতে পারলে নিশ্চিত যে, অমন কিছু করতে পারব৷
ওই ৯৫ রানের ইনিংসটি বাদ দিলে গত বিশ্বকাপে আপনার বাকি ইনিংসগুলো ১৯, ০, ২, ১৩, ২৫ রানের৷ অনেক সমালোচনা হয়েছে তখন৷ আপনার পরিবারকে আক্রমণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিছু লেখা হয়েছে৷ সময়টা কতটা কঠিন ছিল?
আমার জন্য খুব কঠিন ছিল৷ কারণ, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা করলে তা আমি পড়তাম৷ দেখে খারাপ লাগতো৷ শুধু আমার পর্যন্ত গেলে তা-ও মেনে নিতাম, কিন্তু যখন পরিবার পর্যন্ত চলে যায়, তা মেনে নেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে৷ তবে এখন মনে হয় আমি আগের চেয়ে মানসিকভাবে শক্ত৷ সবকিছু আর গোনার মধ্যে ধরি না৷ আমি বিশ্বাস করি, এ জিনিসগুলো আবার হবে৷ জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে অমন সমালোচনা আবার হবে৷ এখন আমি আশা ও প্রার্থনা করি যে, গতবার যেভাবে তা সামলেছিলাম, সামনের বার যেন এর চেয়ে ভালোভাবে সামলাতে পারি৷
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে যায়, সেখানে শেষ দিকে আপনি একটি ক্যাচ ছাড়েন৷ জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের যখন প্রয়োজন ১৫ বলে ১২ রান, তখন ফেলেন ক্রিস ওকসের তুলে দেয়া ক্যাচ৷ কখনো কি পরে মনে হয়েছে, ওই ম্যাচ বাংলাদেশ হেরে গেলে আপনার কী হতো?
এখনো মনে হয়৷ এখনো বিষয়টি নিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনা করি৷ যখন কেউ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ ছাড়ে, তখন নিজের উদাহরণ দিই, বলি, ‘এমন তো হতেই পারত যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ আমি ছেড়েছি৷’ বাংলাদেশ হেরে গেলেই তা হতো৷ বিশ্বকাপের ঠিক পরের সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফর্মে ফিরি৷ কিন্তু যদি আমার ওই ক্যাচ ফেলায় বাংলাদেশ হেরে যেতো, তাহলে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজটি হয়তো খেলাই হতো না৷ একটি গল্প আপনাকে বলি, যা কখনো কাউকে বলিনি৷ ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচের ঠিক পরের খেলা নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে৷ তাতেও জয়ের মতো অবস্থায় ছিলাম৷ খুব উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে আমি ফিল্ডিং করার জন্য হেঁটে হেঁটে লং অনের দিকে যাচ্ছিলাম৷ ঠিক যে পজিশনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যাচ ছেড়েছি৷ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই লং অনে হেঁটে যাবার মাঝপথে দাঁড়িয়ে যাই৷ অন্য কাউকে খোঁজা শুরু করি, যে কিনা ওই লং অনে ফিল্ডিং করবে৷ এরপর কী হলো, জানি না৷ ভেতর থেকে শুনতে পেলাম যেন কেউ বলছে, আজ যদি আমি এ জায়গা থেকে চলে যাই, তাহলে জীবনে আর কোনোদিন লং অনে ফিল্ডিং করতে পারব না৷ ভয় আমাকে গ্রাস করে নেবে৷ ১০ সেকেন্ডের জন্য তাই দাঁড়ালাম, এরপর ঠিক ওই লং অনে গিয়ে ফিল্ডিং শুরু করি৷ ওই মুর্হর্তটাতেই আমি জিতে যাই৷ আমি ক্যারিয়ারে অনেক দুর্দান্ত ক্যাচ ধরেছি; আবার ক্যাচ ফেলেছিও৷ ভবিষ্যতেও এমনটা হবে৷ কিন্তু একটা জিনিস নিশ্চিত, আমি আর ফিল্ডিং করতে গিয়ে কখনো ভয় পাবো না৷
বিশ্বকাপ পরবর্তী সিরিজে ফর্মে ফেরার কথা বলছিলেন৷ আমার পরের প্রশ্ন সেটি নিয়েই৷ পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম দুই ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি করেন; টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি৷ এই ফর্মে ফেরা আপনাকে কতটা নির্ভার করে?
অনেক৷ কারণ, আমি খুব চাপে ছিলাম৷ ক্যারিয়ারে সম্ভবত ওই প্রথমবারই জানতাম না যে, আমি খেলব কিনা৷ সবসময় এমন হয়েছে যে, ফিট থাকলে আমি খেলবই৷ তা নিশ্চিত হবার জন্য দল ঘোষণার প্রয়োজন পড়েনি৷ কিন্তু সেবার আমি একাদশ ঘোষণার অপেক্ষা করছিলাম৷ এরপর প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি করলাম; দ্বিতীয় ম্যাচেও সেঞ্চুরি, তৃতীয় ওয়ানডেতে ষাটের ঘরের ইনিংস৷ টেস্টে করি ডাবল সেঞ্চুরি৷ ওই এক মাসে আমার জীবন একেবারে ঘুরে গেল৷ তাই খুব নির্ভার হয়েছিলাম৷ সঙ্গে আরেকটি জিনিসও বুঝতে পারি– এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে প্রতিনিয়ত নিজের উন্নতি করতে হবে৷ তখন পর্যন্ত ফিটনেসকে আমি খুব একটা গুরুত্ব দিইনি৷ মনে হয়েছে, ভালো খেললে মানুষ মুখ বন্ধ রাখবে, খারাপ খেললে কথা বলবেই৷ কিন্তু ওই সময়ের পর ভেবেছি, ফিটনেস খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ ক্যারিয়ারে ৫০-৬০-৭০ রানের ইনিংসগুলো খেলে যে আউট হয়ে গেছি, এর বড় কারণ সম্ভবত সেঞ্চুরি করার মতো ফিটনেস আমার ছিল না৷ সেকেন্ডের ভগ্নাংশে যে মনোযোগ সরে গেছে, তা ফিটনেসের কারণে৷ ফিটনেসের দিক দিয়ে এখনো আদর্শ অবস্থায় যাইনি৷ তবে ফিটনেসকে অন্তত গুরুত্ব তো দিচ্ছি৷ সেটি হয়েছে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে৷
২০১৫ বিশ্বকাপের পর আপনার ব্যাটিংয়ে রূপান্তর বিস্ময়কর৷ বিশেষত ওয়ানডে ফর্ম্যাটে৷ তখন পর্যন্ত খেলা ১৪১ ওয়ানডেতে আপনার গড় ছিল ২৯ দশমিক ৬৭; সেঞ্চুরি ছিল ৪টি৷ বিশ্বকাপের পর খেলা ৪৫ ওয়ানডেতে আপনার ব্যাটিং গড় ৬২ দশমিক ৮৩; করেছেন ৭ সেঞ্চুরি এবং ১৬ হাফ সেঞ্চুরি৷ বিশ্ব ক্রিকেটের হিসেব ধরলে এ সময়ে আপনার চেয়ে ভালো ওয়ানডে ব্যাটিং গড় কেবল কোহলি, রস টেলর ও রোহিত শর্মার৷ বিশ্বকাপের সমালোচনাই কি এই রানক্ষুধা, এই সাফল্যক্ষুধার জন্য আপনাকে তাতিয়ে তুলেছিল?
হ্যাঁ, আমার মনে হয়, বিশ্বকাপের সমালোচনার পর পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে ওভাবে ফর্মে ফেরাটা আমাকে আরো নিরহঙ্কার করেছে; সেটি জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতিও৷ একটা সময় মানুষ আমাকে প্রচন্ড অহঙ্কারী হিসেবে দেখতো৷ এখনো মানি না যে, আমি কখনো তেমন ছিলাম৷ কিন্তু লোকে তাই ভাবতো৷ ওই ঘটনাগুলোর পর আমি আরো অনেক নিরহঙ্কার হয়েছি৷ এত এত রান করার পরও কখনো ভাবিনি যে, ‘দেখো, আমি কী করছি’৷ এমন একটা প্র্যাকটিস সেশন নেই, যেখানে আমি নিজের উন্নতির চেষ্টা করিনি৷ এখন পর্যন্ত যা করেছি, সেটি ভালোই৷ কিন্তু এর চেয়ে ভালো করার সামর্থ্য আমার রয়েছে বলে মনে করি৷
তিন ফর্ম্যাটেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান আপনার৷ টেস্টে ৪০৪৯, ওয়ানডেতে ৬৪৫০, টি-টোয়েন্টিতে ১৬১৩৷ এ বিষয়টি কতটা তৃপ্তি দেয়?
এসব নিয়ে আমি এক ফোঁটাও ভাবি না৷ ভাবি না এ কারণেই যে, রেকর্ডগুলো এক দিন ভেঙে যাবে৷ কেউ না কেউ ভেঙে দিবে৷ কিন্তু যদি ১০ হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছাতে পারতাম, আট হাজার রান, সাত হাজার রান– এমন কিছু বরং আমাকে আনন্দ দেবে…
কিন্তু মনে হয় না, সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড আমি এমন জায়গায় রেখে যাব, যা ভাঙা অন্যদের জন্য খুব কঠিন হবে?
অব্যশই নিজের রান এমন জায়গায় রেখে যেতে চাই, যেন খুব সহজে তা অন্যরা ভেঙে দিতে না পারে৷ তিন ফর্ম্যাটে দেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড অনেকদিন ধরে নিজের দখলে রাখার এমন অনন্য অর্জন অন্যদের জন্য হয়তো কঠিন হবে৷ তবে সত্যি বলতে কী, এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমি খুব একটা ভাবি না৷ খুব সিরিয়াসলি নিই না৷ রেকর্ডগুলো থাকা ভালো৷ কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি করে যে জিনিসটি চাই, তা হলো ‘লিগ্যাসি’৷ কত রান করলাম, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ কী লিগ্যাসি রেখে গেলাম, তাই আমার কাছে বড় ব্যাপার৷ আমি ক্রিকেট ছাড়ার পরও ক্রিকেটাররা যেন আমার উদাহরণ দেয়৷ ‘এই ছেলেটি সাত হাজার/আট হাজার রান করেছে’, তা বলার চেয়ে ওই লিগ্যাসি রেখে যেতে চাই৷ শ্রীলঙ্কায় মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারা যেমন লিগ্যাসি রেখে গেছেন৷ এখনো আমি তেমন কিছু করতে পারিনি৷ কিন্তু আগামী যে ছয়-সাত বছর খেলব, তাতে এমন কিছু অর্জন করতে পারলে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব গর্বিত হব৷
আরো কিছু অনন্য অর্জন রয়েছে আপনার৷ তিন ফর্ম্যাটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি যেমন৷ টেস্টে আট সেঞ্চুরির রেকর্ড স্পর্শ করেছেন মোমিনুল হক৷ ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ১১টি, টি-টোয়েন্টিতেও দেশের একমাত্র সেঞ্চুরিয়ান আপনি৷ যতই গুরুত্ব না দেন, কিন্তু ক্রিকেট তো রেকর্ড-পরিসংখ্যানেরই খেলা৷ এমন রেকর্ড যখন দেখেন, তা কি নিজেকে আরো ভালো করার জন্য অনুপ্রাণিত করে না?
অবশ্যই৷ অব্যশই ভালো লাগে৷ মোমিনুল যখন আমার আট সেঞ্চুরির রেকর্ড স্পর্শ করেছে, তখন মনে হয়েছে, ‘এই ছেলেটি আমার চেয়ে ৩০ কিংবা ২০ ম্যাচ কম খেলে (আসলে ২৩ ম্যাচ; তামিম টেস্ট খেলেছেন ৫৬টি, মোমিনুল ৩৩টি) আট সেঞ্চুরি করেছে৷ এখন পরের ২৫ টেস্টে আমি যদি খুব ভালো করি, তাহলে ওর সঙ্গে আবার পার্থক্যটা বাড়িয়ে নিতে পারব৷’ এটি আমার ও মোমিনুলের মধ্যে চ্যালেঞ্জ; স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা৷ এমন নয় যে, নিউজিল্যান্ডে সেঞ্চুরি করে ও যদি আমার চেয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে আমার খারাপ লাগবে৷ আমি তেমন মানুষ নই৷ ব্যাপারটিকে বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবো৷ সেঞ্চুরির সুযোগ পেলে যেন সেঞ্চুরি করতে পারি, তা নিশ্চিত করতে চাইবো৷ আগেও কেউ কেউ সেঞ্চুরি সংখ্যায় আমার কাছাকাছি এসেছিল৷ এরপর হয়তো কয়েকটি সেঞ্চুরি করে এগিয়ে গেছি৷ এবারও একই চেষ্টা থাকবে৷
বছর কয়েক আগে আপনার ও সাকিব আল হাসানের ওয়ানডে রান অমন কাছাকাছি ছিল৷ এখন আপনি সাকিবের চেয়ে ৮৭৩ রানে এগিয়ে গেছেন…
অথচ সাকিব আমার আগেই পাঁচ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিল৷
পরিসংখ্যানে অন্য রকম ‘হ্যাটট্রিকের হ্যাটট্রিক’ হবার খুব কাছাকাছি আপনি৷ বাংলাদেশের হয়ে তিন ফর্ম্যাটে সর্বোচ্চ রান, তিন ফর্ম্যাটে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মতো তিন ফর্ম্যাটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস হচ্ছে না একটুর জন্য৷ ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৯ সালের ১৫৪ রান এখনো সর্বোচ্চ, টি-টোয়েন্টিতে ওমানের বিপক্ষে ২০১৬ সালের অপরাজিত ১০৩ রানও৷ টেস্টে ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০৬ রানের ইনিংসটি দেশের সর্বোচ্চ ছিল৷ পরে তা ভেঙে দেন সাকিব, গত বছর তা-ও পেরিয়ে যান মুশফিক৷ এটি আবার নিজের কাছে ফেরানোর ইচ্ছে করে না?
কেন নয়? মুশি যখন প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করে, আমি সে রেকর্ড ভাঙতে চেয়েছি৷ আমি নিশ্চিত যে, অন্যরাও চেয়েছে৷ ভাগ্যবান যে, আমি করতে পেরেছি৷ পরে সাকিব আমাকে পেরিয়ে গেল৷ তখন আমার, মুশফিকের এবং আরো অনেকের ইচ্ছে জাগল, তা পেরিয়ে যেতে হবে৷ মুশফিক সেটি পারল৷ এখন আবার একই অবস্থা৷ যদি সুযোগ পাই, তাহলে এতটুকুন বলব যে, আমি ছাড়ব না (হাসি)৷
ট্রিপল সেঞ্চুরি?
হতেও পারে, কেউ জানে না!
সব ফরম্যাট মিলিয়ে আপনার সেরা ইনিংস যদি বেছে নিতে বলি?
যদি জিজ্ঞেস করেন, কোনটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি, তাহলে ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ঢাকায় ১২৫ রানের ইনিংসটির কথা বলবো৷ আমরা ম্যাচ হেরেছি, কিন্তু আমার জন্য সেটি খুব স্পেশাল ইনিংস৷ টেস্টে ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকার সেঞ্চুরিটি৷ ওই উইকেটে কীভাবে যে সেঞ্চুরি করেছি! অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে দুই ইনিংসেই সত্তরোর্ধ রানের ইনিংস খেলি৷ তবে তা ছাপিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের ৭৮ রানের ইনিংসটি খুব স্পেশাল৷ কারণ, জীবনে প্রথমবারের মতো আমি অমন উইকেটে ব্যাটিং করতে নামি৷ ঘরোয়া ক্রিকেটেও কখনো অমন উইকেটে ব্যাটিং করিনি৷
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন প্রায় ১২ বছর৷ কখনো কোনো ব্যাটসম্যানকে দেখে মনে হয়েছে, ‘ইস্, যদি ওর মতো ব্যাটিং করতে পারতাম!’
খুব সহজ উত্তর, ভাই– বিরাট কোহলি৷
ব্রায়ান লারার ব্যাটিং সেভাবে দেখেননি, বোঝা গেছে৷ আপনার শুরুর সময়ই তো লারার শেষ হয়ে গেল…
আসলে এখন ক্রিকেটের প্রতিটি খুঁটিনাটি যেভাবে দেখি কিংবা বোঝার চেষ্টা করি, ওই সময় হয়ত সেভাবে দেখতাম না৷ ব্রায়ান লারা ব্যাটিং করছে, তা দেখেই খুশি৷ সনত্ জয়াসুরিয়া ব্যাটিং করছে, এতেই খুশি৷ কিন্তু এখন যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কার মতো ব্যাটিং করতে চান’, তাহলে আমি বলবো বীরেন্দর শেবাগের মতো৷ পৃথিবীতে অনেক বড় বড় হিটার এসেছেন৷ কিন্তু শেবাগের মতো তিন ফর্ম্যাটে এমন দাপট নিয়ে কেউ খেলেছেন বলে আমার মনে হয় না৷ এ কারণেই কার মতো ব্যাটিং করতে চাই–এর উত্তরে শেবাগের কথা বলবো৷
মুখোমুখি হওয়া বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন?
সেরা সময়ের সাঈদ আজমলকে খেলা ছিল খুব কঠিন৷ মর্নে মরকেলকেও৷ রবিচন্দ্রন অশ্বিনকেও৷ আসলে এমন অনেক বোলার রয়েছেন, যাদের মুখোমুখি হওয়াটা মোটেই আনন্দদায়ক না৷ বললে তাই অনেকের নাম বলতে হবে৷
সাক্ষাত্কারের শেষ পর্যায়ে এসে একটু অধিনায়কত্ব নিয়ে কথা বলতে চাই৷ গত নিউজিল্যান্ড সফরেই বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে একমাত্র ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন; ক্রাইস্টচার্চে দ্বিতীয় টেস্টে৷ সমসাময়িকদের মধ্যে সাকিব অনেক দিন জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মুশফিক অধিনায়ক ছিলেন অনেক দিন; মাহমুদ উল্লাহও বেশ কিছু ম্যাচের অধিনায়ক৷ আপনি সাকিবের সহ-অধিনায়ক ছিলেন অনেক দিন; পরবর্তীতে টেস্টে মুশফিুকের সহ-অধিনায়ক৷ তাই কি মনে হয় না, জাতীয় দলের নেতৃত্বটা আপনিও পেতে পারতেন?
দেখুন, অধিনায়কত্ব এমন একটি ব্যাপার, যা নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাই না৷ মোটেও না৷ এর অন্যতম কারণ হলো, যে সময় আমি অধিনায়কত্ব নিয়ে ভাবা শুরু করতাম, যখন আমি প্রথম সহ-অধিনায়ক হই, তখন নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারতাম, ‘আমি ভবিষ্যতে অধিনায়ক হলে কিভাবে কি করব’–তখনই অকারণে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে যায়৷ আমার খুব খারাপ লাগে৷ কারণ, আমি মনে করি না, কোনো ভুল তখন করেছিলাম৷ পরবর্তীতে আবার আমি সহ-অধিনায়ক হই৷ অধিনায়ক মুশফিক ইনজুরিতে পড়ে, আমার অধিনায়ক হবার কথা, অথচ বিসিবি তখন আরেকজনকে অধিনায়ক বানায়৷ এটি আমার জন্য খুব অপমানজনক ছিল৷ এরপর আবার আমি সহ-অধিনায়ক হই৷ আবারও গত চার-পাঁচ বছরে খুব ভালো পারফর্ম করা সত্ত্বেও আমার জায়গায় আরেকজনকে আনা হয়৷ সেটিও কোনো কারণ ছাড়া৷ এসব ঘটনায় অধিনায়কত্বের প্রতি আমার আগ্রহ হারিয়ে যায়৷ একেবারে আগ্রহ হারিয়ে যায়৷ এখন আর অধিনায়কত্ব নিয়ে মোটেই ভাবি না৷ কেউ যদি এসে অধিনায়কত্বের কথা বলে, তাহলে প্রথমেই বলবো– নেতৃত্ব আমি চাই না৷
অধিনায়কত্ব নিয়ে ভাবেন না ঠিক আছে, তাই বলে চানও না?
না, আমি আর অধিনায়ক হতে চাই না৷ দেখুন, কেউ অধিনায়ক হয়ে জন্মায় না৷ এমএস ধোনি সাম্প্রতিক সময়ের সম্ভবত সফলতম অধিনায়ক৷ কিন্তু ভারতের অধিনায়ক হবার আগে তিনি কোনো পর্যায়েই অধিনায়কত্ব করেননি৷ রাজ্য পর্যায়েও না৷ অধিনায়ক তাই তৈরি করতে হয়৷ সহঅধিনায়ক বানাতে হয়, একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে হয়৷ আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি৷ এ কারণেই অধিনায়কত্ব নিয়ে আমার আগ্রহ মরে গেছে৷ এখনো দেখবেন, ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময়ও দলের কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে প্রথম যে কথাটি বলি, তা হলো, আমি অধিনায়কত্ব চাই না৷ মাঠে সব করবো, সেটি ভিন্ন ব্যাপার৷ কিন্তু অধিনায়ক হতে চাই না৷ কারণ, আমি একটা এমন ছেলে, যে কিনা এসব নিয়ে ভাবি না৷ আমার জীবনে অধিনায়কত্ব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না৷
একেবারে শেষ প্রশ্ন৷ এই মুহূর্তে ক্রিকেট নিয়ে আপনার কী স্বপ্ন? দীর্ঘমেয়াদের স্বপ্ন কী, কিংবা বিশ্বকাপ সামনে রেখে নিজের ও দলের সম্ভাব্য অর্জনের জায়গা থেকে স্বপ্নের কথাটি যদি বলেন…
দীর্ঘমেয়াদের স্বপ্ন বললে আমি টেস্ট কিংবা ওয়ানডে কোনো এক ফর্ম্যাটে ১০ হাজার রান করতে চাই৷ ওয়ানডেতে যদি ২০ থেকে ২৫টি সেঞ্চুরি করতে পারি, তাহলে ভীষণ গর্বিত হব৷ আর ঠিক সামনের লক্ষ্যের কথা বললে, আমি অনেক বেশি ফিট হতে চাই৷ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে কারণে৷ অনেকে ভাবছে, আমি কেন খেলব না! মনে রাখতে হবে, ওখানে খেললে ২৫-৩০ লাখ টাকাও কিন্তু পেতাম৷ ২৫-৩০ লাখ টাকা অনেক টাকা৷ তা আমি ছাড় দিচ্ছি, কারণ, ওই এক মাস কেবলই নিজের ফিটনেসে মনোযোগ দিতে চাই৷ দেখতে চাই, আমি আগের চেয়ে ফিট হয়েছি এবং এর ভালো ফল পাচ্ছি৷ আরো ফিট হলে মাঠে কেমন লাগবে, সেটি দেখতে চাই৷ এ কারণে ফিটনেসে আরো জোর দিতে চাই৷
আর বিশ্বকাপ? ধরুন সর্বোচ্চ স্কোরার হওয়া বা এ জাতীয় কোনো লক্ষ্য?
তেমন কোনো লক্ষ্য ঠিক করে খেলি না৷ কারণ, যখনই তা করেছি, লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি৷ আমার কথা হলো, প্রতিটি ম্যাচে নিজের সর্বোচ্চ ঢেলে দেবো৷ যখনই ব্যাটিংয়ে যাই, মানসিকতা যেন একই থাকে৷ আর দল হিসেবে যদি বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারি, তাহলে আমি খুবই খুশি হবো৷
সেমিফাইনালে পৌঁছলে এরপর দেখা যাবে কী হয়!
সূত্র : ডয়চে ভেলে