সব সময় ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরেন। কথা বার্তা শুনে অপরিচিত যে কেউই বলবেন এত ভদ্র লোক আর হয় না। বয়সও ৫৫ বছর পেরিয়েছে। সবদিক থেকে লোকটাকে পরিপাটিই মনে হয়। নাম তার বিল্লাল। সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল এলাকার লোকজন জানেন বিল্লাল ‘কক্সবাজার টু ঢাকা’ কোনো বড়ধরনের ব্যবসায় করেন।
অথচ এই বিল্লালই বড় ধরনের মাদককারবারির সাথে জড়িত। পেটের ভেতরে করে ইয়াবা পাচার করে সে। দীর্ঘ দিনের এই মাদকপাচারকারী অবশেষে গত ২৯ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল বাসভবন থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। বিল্লালের পেটের ভেতর থেকে ২২ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় গ্রেফতার হয় তার স্ত্রী ও ছেলে। তারাও মাদককারবারের সাথে জড়িত বলে র্যাব জানায়।
এরপরই ১১ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের সীমান্ত এলাকা রাজধানীর মাতুয়াইল থেকে তাজুল ইসলাম সাগর নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে র্যাব। পেটের ভেতরে দুই হাজারের বেশি ইয়াবা বহনকালে গ্রেফতার হয় সে। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে পেটের ভেতর থেকে ওই ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
গত ৩০ জানুয়ারি পেটের ভেতর বহন করে ইয়াবাপাচারকালে পাঁচ যুবককে গ্রেফতার করে নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১-এর একটি দল। কক্সবাজার থেকে আসার পথে কুমিল্লার পদুয়ার বাজারে তাদের গ্রেফতার করে। মাদকপাচারকারী এই পাঁচ যুবকের পেটের ভেতর থেকে অন্তত ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে র্যাব। আটককৃতরা হলো বরিশাল জেলার রাসেল সিকদার ও রেজাউন সর্দার, জামালপুরের সাদ্দাম হোসেন, লক্ষ্মীপুরের রিয়াজ হোসেন এবং নাটোরের রাশেদুল ইসলাম।
আগে পেটের ভেতর করে সোনা পাচারের ঘটনা ঘটত তবে সম্প্রতি মাদকপাচারকারীরা পেটের ভেতর করে ইয়াবা পাচারের কৌশল নিয়েছে। ২০-৩০টি ইয়াবার পোটলা বেলুনের ভেতরে ভরে তা পানি দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলে এভাবে বিপুল ইয়াবা পেটে ভরে পাচার করে তারা। পরে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে তা বের করা হয় মলত্যাগের মাধ্যমে। চোরাকারবারিরা সাধারণ বহনকারীদের অর্থের লোভ দেখিয়ে প্রাণঘাতী এই কৌশলে ইয়াবা বহন করছে।
ইয়াবা পাচারের নতুন কৌশলে হতবাক গোয়েন্দারা। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পেটের ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে বহন করায় যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। এরই মধ্যে কয়েকজন মৃত্যুরকোলে ঢলেও পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডা: জহির আলম জানান, এটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। পেটের ভেতরে ইয়াবা ঢোকানো হলে যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। বিশেষ করে পলিথিন বেলুন পেঁচিয়ে ইয়াবা পেটে ঢোকানো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যেকোনো সময় পলিথিন ফেটে বা লিক হয়ে ইয়াবা পাকস্থলীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, ‘পেটের ভেতরে ইয়াবা ঢোকালে প্রাথমিকভাবে পেটব্যথার উপসর্গ দেখা যেতে পারে। যদিও চোরাকারবারিরা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এসব আবার বের করে ফেলে। তবে ধারাবাহিকভাবে এই কাজে কেউ লিপ্ত থাকলে তার দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
ঢাকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, পেটের ভেতর ইয়াবা বহনের প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। লোভে পড়ে মাদক চোরাকারবারিরা আত্মঘাতী এ কৌশল বেছে নিচ্ছে। কারণ, কক্সবাজার থেকে একটি চালান ঢাকায় আনতে পারলে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পায় বহনকারিরা। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরাও তাদের স্বীকারোক্তিতে বলেছে, অর্থের লোভেই তারা এমন ভয়ঙ্কর কৌশল বেছে নিয়েছে। গত দুই বছরে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৫০ জন মাদক বহনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের পেটের ভেতর থেকে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
এ দিকে মাদক পাচারের ক্ষেত্রে দেশের অন্যতম ধনী জেলা নারায়ণগঞ্জকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করায় এ অঞ্চলে মাদকের বিস্তার রোধ কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে কয়েকদিন বন্ধ থাকলেও পরে পুরোদমে আবার শুরু হয় মাদক পাচার। তবে সম্প্রতি জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করছেন। গত এক মাসে প্রায় চার শতাধিক মাদকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জের সাতটি থানার মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা ও রূপগঞ্জ থানা এলাকা সরাসরি রাজধানী ঢাকার সাথে যুক্ত। এর মধ্যে সোনারগাঁও উপজেলা দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রূপগঞ্জ উপজলা হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এবং নদীপথে নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরের সাথে বিভিন্ন জেলার আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা চালু আছে।
রাজধানী লাগোয়া শহর হওয়ায় ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো হয়ে নারায়ণগঞ্জকে নিরাপদ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদককারবারিরা। ভারত থেকে ফেনসিডিল আর মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার হয়ে যেসব মাদক বাংলাদেশে আসে সেগুলোর ডিস্ট্রিবিউশন (বণ্টন) পয়েন্ট হিসেবে মাদককারবারিরা নারায়ণগঞ্জকেই ট্রানজিট রুট হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। জানা যায়, আশির দশক থেকেই নারায়ণগঞ্জকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পর মূলত বাংলাদেশে মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রথম দিকে কুমিল্লা ও ফেনী সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পাচার হয়ে আসে হেরোইন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানের মুখে হেরোইন আসা কিছুটা কমলেও শুরু হয় ফেনসিডিল পাচার।
দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলেও এ রুট দিয়ে মাদক পাচার বন্ধ করা যায়নি। আর ২০০৭ সালের দিকে কক্সবাজার টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িয়ে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশে ঘটে ইয়াবার।
নারায়ণগঞ্জকে মাদকের গোল্ডেন ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না এমনটি জানান জেলা পুলিশের একজন শীষ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান ক্লিয়ার (পরিষ্কার)। মাদক কারবারের সাথে যারাই যুক্ত থাকুক সেখানে পুলিশ সদস্য হোক বা অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হোক কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
পাশাপাশি আমরা প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি এলাকায় মাদক নির্মূলে সভা ও সমাবেশ করা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি, মাদকের সাথে যুক্তদের পুর্নবাসনের চিন্তাভাবনা করছি। জনসাধারণ ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে এ সমস্যা সমাধান করা অনেকটাই সম্ভব হবে।