স্বাস্থ্যবিধি মানাতে নিতে হবে জোর পদক্ষেপ

দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার প্রায় ২৯ শতাংশ। এতে ভাইরাসটির তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যবিদরা করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ মানার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলেন, দেশে গত ১৫ দিনে করোনা আক্রান্ত রোগী ছয় গুণ বেড়েছে। এ অবস্থায় বিধিনিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সঙ্গে সবখানে স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি হয়ে পড়েছে।

মাস্ক ব্যবহারে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, দেশে করোনার ধরন ডেল্টার সঙ্গে ওমিক্রন হু হু করে বাড়ছে। দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা, শনাক্ত হার আগের দিনের রেকর্ড ভাঙছে। ফলে সব জনগণের আরও কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা দরকার। অন্ততপক্ষে সবাই যেন মাস্ক ব্যবহার করে সে ব্যাপারে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না।

তিনি আরও বলেন, করোনা প্রতিরোধে সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরা, নিয়মিত উত্তমরূপে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলাফেরা করার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। কারণ দেশে এ মুহূর্তে ভাইরাসটির তৃতীয় ঢেউ চলছে। আরও কিছুদিন এভাবে চলবে।

যে কোনো ঢেউ বাড়তে বাড়তে তা পিক লেভেলে (সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো) যায়। তারপর একসময় কমতে থাকে। কিন্তু দেশে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ থাকলেও সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় সরকারও কিছু করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে শুধু প্রশাসনকে দোষারোপ করলে চলবে না, জনগণের দায়িত্ব আছে নিজের সুরক্ষার ব্যাপারে। মানুষ বেখায়ালি হলে শত নির্দেশনায়ও কিছু হবে না।

এ ক্ষেত্রে প্রশাসন তার কাজ করবে, সঙ্গে জনগণের নাগরিক দায়িত্ব পালন করা উচিত। অন্যদিকে প্রশাসনকে শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না। মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। এ জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদেরকে গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় কমিটি করে স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, ধর্মীয় গুরু, সুশীল সমাজ সবার মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে টিকাদান ও স্বাস্থ্যবিধি মানা এ দুটি পথই রয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

করোনা প্রতিরোধ কমিটিকে কাজে লাগাতে হবে : সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, দিন দিন সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। এই সংখ্যা পঞ্চাশ, ষাট এমনকি সত্তর হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এখন বেশি জোর দিতে হবে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোয়। এজন্য জেলা-উপজেলা এবং মহানগরীতে যে করোনা প্রতিরোধ কমিটি আছে, তাদের কাজে লাগাতে হবে।

এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, মাঠ পর্যায়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত কমিটিকে জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, শিক্ষক, এনজিও কর্মীসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক কাজ করতে হবে। করোনা শনাক্ত রোগী ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে, যাতে হাসপাতালের ওপর চাপ না পড়ে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনসমাগমপূর্ণ জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি পালনে জোর দিতে হবে। এখনো যারা টিকার আওতায় আসেননি তাদের টিকার ব্যবস্থা করতে হবে।

এজন্য গ্রাম ও শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক কাজ করতে হবে। সবার আগে সরকারকে রাজধানীতে এটি বাস্তবায়ন করে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তা গ্রামপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনা মোকাবিলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করা ছাড়া শুধু নির্দেশনা, সরকারি-কর্মকর্তা ও পুলিশ দিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আর মানুষ যাতে নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব নেয় এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু অর্থকড়ি খরচ হলেও তার অনেক গুণ আমাদের উপকার দেবে। লাখ লাখ মানুষকে গুরুতর অসুস্থতা থেকে বাঁচাবে। স্বাস্থ্যের খরচ ছাড়াও অর্থনীতিকেও রক্ষা করবে। না হলে একসময় সবকিছু বন্ধ করে দিতে হবে। তাতে সবদিক থেকেই ক্ষতির কারণ হবে।

দুই সপ্তাহে হাসপাতাল রোগীতে পূর্ণ হতে পারে : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশের আরও প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। যে কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার বেশি হবে। সংক্রমণের হার এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালগুলো রোগীতে পূর্ণ হয়ে যাবে। এজন্য সরকারের উচিত গণহারে মাস্ক বিতরণ করা, মানুষকে তা পরতে বাধ্য করা। গণমাধ্যমসহ সবাই তা প্রচারে ভূমিকা রাখা।

তিনি বলেন, দেশে ইতোমধ্যে হাসপাতালে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ বিছানায় রোগী ভর্তি আছে। হাসপাতালের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে ঢাকা শহরের কোনো হাসপাতালের বিছানা আর খালি থাকবে না।

অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, দেশে দৈনিক সংক্রমণ বেড়ে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার হতে পারে। করোনা আক্রান্তদের সাধারণ হিসাব হচ্ছে দশমিক থেকে দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু সেটা সেই জনগোষ্ঠী, যাদের ৫০ শতাংশের উপরে টিকাদান হয়ে গেছে।

এছাড়া আগের ঢেউ ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরিমাণ কম থাকে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত টিকা নিয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ। এখনো ৬০ শতাংশ মানুষ টিকার বাইরে।

Share this post

scroll to top