রাহেলা খাতুনের তিন সন্তান। তিন জনই অসুস্থ। তাদের কান্নায় আশপাশের পরিবেশও ভারি হয়ে উঠেছে। ডাক্তার আপা জানিয়েছে তারা তিনজনই চিকেন পক্স’এ আক্রান্ত। কথাগুলো বলছেন মিয়ানমার সরকারের অত্যাচারে অতিস্ট হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা একজন রোহিঙ্গা শরনার্থী। মুলত মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার নিপীড়নে জর্জরিত হয়ে ২০১৭ সালের সেপ্টম্বর-অক্টোবর মাস থেকে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা সদস্যদের বাংলাদেশে আসার ঢল নামে। এসময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তার সাথে রয়েছে পুরনোরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা সংখ্যা এখন প্রায় ১২ লাখ। যাদেরকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। এসব রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় খোলা হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র। যা রোহিঙ্গা শিবির হিসেবে পরিচিত।
শুধু রাহেলার সন্তান নয়। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়ায় বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিবিরের অধিকাংশ শিশু, মহিলা এমনকি প্রাপ্ত বয়স্ক অনেকেই চিকেন পক্স’এ আক্রান্ত। এর মধ্যে তিন বছরের এক শিশু মারাও গেছে।
রাহেলা জানান, প্রথমে আমার মেঝ ছেলের শরীরে দানা দানা দেখা যায়, একদিন পরেই দেখি তা পুরো শরীরে। প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছেলে খুব কান্নাকাটি করতে থাকে। পরে আমার স্বামী দ্রুত ডাক্তার আপাকে ডেকে নিয়ে আসে। এর মধ্যেই দেখি বড় মেয়ে আর ছোট মেয়েরও একই অবস্থা। ঔষধ খাওয়ানোর পর থেকে এখন কিছুটা ভালোর দিকে।
রাহেলার পাশের বাসায় থাকেন জরিনা। তার চার সন্তান। তিন সন্তানই চিকেন পক্স’এ আক্রান্ত। জরিনা বলেন, সারারাত ঘুমাতে পারি না। একজনের কান্না থামলে আরেকজনের শুরু হয়। আবার সারা শরীর চুলকায়। ডাক্তার আপা হাত দিয়ে চুলকাতে নিষেধ করেছে। নিম পাতা গায়ে বুলিয়ে দিই। তারপর বাচ্চারা একটু শান্ত হয়।
জানা যায়, কক্সজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে গত ডিসেম্বর হতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩৩০ জন বিভিন্ন বয়সের মানুষ চিকেন পক্স’এ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশ উখিয়ায় এবং ৪৭ শতাংশ টেকনাফে। আবার এরমধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই হচ্ছে শিশু।
এ রোগ ছড়ানোর আগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যাপক আকারে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে অনেক দেশী-বিদেশী উন্নয়ন সংস্থা- এনজিও।
কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আব্দুল মতিন বলেন, চিকেন পক্স ‘ভারিচেলা’ নামেও পরিচিত। মূলত ভারিচেলা জোস্টার ভাইরাসের কারনে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ মূলত শিশুকালেই হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় প্রাপ্ত বয়স্করাও এ রোগে আক্রান্ত হয়।
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আপনা-আপনি এ রোগ সেরে যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা দ্বিতীয় স্টেজে চলে গেলে মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে। মূলত ব্যাকটরিয়াল ইনফেকশনের কারনে শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হয়। আবার এ সময় প্রাপ্ত বয়স্করা নিউমোনিয়াও আক্রান্ত হতে পারে।
ডা. মতিন বলেন, ব্যাপক আকারে যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্মীদের এ বিষয়ে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যাতে করে তারা অতি দ্রুত এ রোগের লক্ষণ সমূহ চিহ্নিত করতে পারে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী এবং ধর্মীয় নেতাদেরও যুক্ত করা হচ্ছে যাতে করে এ রোগ বিস্তৃতি লাভ করতে না পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি ডা. বর্ধন জং রানা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন এনজিও এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা সারাক্ষণ বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে তদারকি করার পাশাপাশি সাধারন রোহিঙ্গাদের সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছি। যেখানেই এ রোগের সন্ধান পাচ্ছি সাথে সাথে সেখানে আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীরা গিয়ে তাদের দেখে আসছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
এছাড়াও স্বাস্থ্য কর্মীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীদের আমরা প্রশিক্ষণ প্রদান করছি যাতে করে তারা দ্রুত এ রোগ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে পারে।
উখিয়া ক্যাম্পে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মী মো. সোহেল উদ্দিন বলেন, কোন এক পরিবারের একজন এ রোগে আক্রান্ত হলে অন্যরাও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশী হয়। তাই আমরা চেষ্টা করছি যাতে করে এটি ছড়িয়ে না পড়ে।
সূত্র : বাসস