সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমস্যা ও সম্ভাবনা : নাছিমা আক্তার

বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার গত ২ অক্টোবর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বেশ কিছু সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। যা ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বেশ কিছু পরিবর্তন খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তিনি তার পোস্টে যা লিখেছেন তা ময়মনসিংহ লাইভ এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়: দু:খ গুলো কোথায় রাখি?

১। সরকারি মাধ্যমিক এ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পদের প্রায় সবগুলোই ফাঁকা। নিয়োগ নাই বহু বছর। আয়া নাই, পিয়ন নাই, নাইটগার্ড নাই ,দারোয়ান নাই।( ছাত্র শিক্ষক এর নিরাপত্তা দেবেন কে?)

সুইপার নাই, ঝাড়ুদার নাই, মালি নাই । ( কিন্তু স্কুল অনেক পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। বাগানে ফুল ফুটতে হয় আমাদেরকেই। )

নিরাপত্তা নৈশ প্রহরী অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় নামে ২০১৪ সালের সেশন আদায়ের পরিপত্রে একটি খাত আছে। ওই খাতে বেসরকারি আদায়:

ক। উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমান এ আদায়ের অনুমতি একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত সর্বউচ্চ বা সর্ব নিম্ন বলে কিছু নেই।

খ। পলিটেকনিক – বার্ষিক ৩৭৫,

গ। মাধ্যমিক এ আদায় মাসে ২০/-টাকা , মানে বছরে ২৪০/-টাকা। এই খাতে একটু বাড়ালে কোন সমস্যাই হবে না। প্রয়োজনে মোট অ্যামাউন্ট ঠিক রেখে খাত গুলোর আন্ত খাত সমন্বয়ে যদি প্রধান শিক্ষকের ক্ষমতাভুক্ত থাকে তাহলেও অনেক সমস্যার সমাধান সহজেই করা সম্ভব।

কোন স্কুলে ২০০০ শিক্ষার্থী থাকলে মাসে ৪০,০০০/-
৫০০০- ৬০০০/- টাকা বেতনে কতজন লোক রাখা যায়? এর পরও ঈদ/ পূজা বৈশাখী ভাতা দিতে হয়।

দিনে রাতে কতজন লোক গেইটে ডিউটি করা উচিত?

এত গুলো ক্লাসরুম, ওয়াশরুম, অভ্যন্তরীণ ড্রেন রাস্তা, বিশাল আঙিনা, সিড়ি , বারান্দা, করিডোর, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, নামাজ ঘর , ওযু খানা পরিষ্কার রাখতে, ময়লা বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতে কতজন লোক নূন্যতম প্রয়োজন?

এরপরেও যদি সীমানা প্রাচীর, দালান, আঙিনা , ল্যাবরেটরি , ছাদ হয় ১০০ থেকে ১৫০ বছর পুরোনো চুন সুরকির ভবন!

চেয়ার , টেবিল, বেঞ্চ মোছা, ঘণ্টা দেয়া, নোটিশ , চিঠি পাঠানো, ব্যাংক, ট্রেজারি, এইসব জায়গায় কতজন লোকের প্রয়োজন?

কাপ প্লেট ধোয়া, চা – নাস্তা শিক্ষার্থীদের টিফিন গণনা, গামলা ধোয়া, এইদিকে কতজন হলে চলে?

বাগান, গাছের পরিচর্যা, মাটি কোপানো, আগাছা পরিষ্কার?

সরকারি মাধ্যমিক এর সবগুলো কাজই নিয়মিত হয়। কিন্তু জনবল নিয়োগ নেই । মাসে ২o টাকা শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় হয়। কোন মানুষকে ৫০০০/-টাকা থেকে ৬০০০/-বেতন দিলে দিনে হয় ২০০ টাকা বা তার কম হয়। অথচ প্রতিমাসে জঙ্গল কাটার জন্য দিনমজুর নিলে দৈনিক সকাল ১০tটা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত কাজ করলে ৬০০ টাকার কম মজুরি নেয় না। অথচ আমাদের দুই শিফটের স্কুলগুলোতে এই বেসরকারি কর্মচারীরা সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কাজ করে।

এভাবে কাজ করানো অমানবিক এবং খুবই কঠিন। এত কম বেতনে লোক পাওয়াও যায় না। অথচ সবগুলো কাজ অত্যাবশ্যকীয়। নিজ হাতে ঝাড়ুদার সুইপারের কাজ করেও আমরা ভয়ে – আতঙ্কে থাকি ।

সরকারিভাবে মাত্র যে গুটিকয়েক জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আছে তারা বদলি হয়ে হয়ে কলেজ গুলোতে বা অফিস গুলোতে থাকতে খুব পছন্দ করে। দুই শিফট এর স্কুল, সারাদিন থাকতে হয় আবার অফিসের মত অনেক সুযোগ সুবিধা থাকেনা। তাই..…

ময়লা আবর্জনা দেখলে আমাদের চাকরিও চলে যেতে পারে তাই আমরা নিজেরাই ময়লা পরিষ্কার করি।

মাঝে মাঝে দশভূজার কথা মনে পড়ে। কী চাপেই গজিয়েছিল এই দশটি বাহু!

কিন্তু শরীর তো একটাই।

হাত বেশি হলে এক জায়গায় বসে অনেক কাজ করা যাবে। কিন্তু ২/৩ জায়গায় কাজ করা যাবে না একসাথে।

আমরা দুই শিফটে প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ আর কি করতে পারি? একাডেমিক কাজের তদারকি। প্রচুর পরিমাণে অফিসিয়াল কাজ করার পাশাপাশি গেইটে দাঁড়ানো সম্ভব না ।

আমরা টয়লেট পরিষ্কার করতে পারব কিন্তু এতগুলো ক্লাস রুম ঝাড়ু দিতে পারব না ।

প্রভু আমাদের কিছু চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী দাও। নইলে অনুভূতিহীন রোবট করে দাও।

সারাদিন স্কুলের পর জুম মিটিং রাতে না হলে ভালো হয়।

২। সরকারি মাধ্যমিক এ গ্রন্থাগারিক এর পদ নাই। কিন্তু সরকারি – বেসরকারি কলেজ এবং বেসরকারি মাধ্যমিক এ আছে। কেন? অথচ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুন্দর মনন গঠনে লাইব্রেরীর ভূমিকা অপরিহার্য । আমাদের লাইব্রেরি আছে লাইব্রেরিয়ান নাই।

৩। সরকারি মাধ্যমিক এ ল্যাব এসিস্ট্যান্ট এর পদ নাই। কিন্তু সরকারি – বেসরকারি কলেজ এবং বেসরকারি মাধ্যমিক এ আছে। কেন?

৪। সরকারি মাধ্যমিক এ আইসিটি শিক্ষকের এর পদ নাই। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইসিটি শিক্ষকের পদ সৃষ্টির গুরুত্ব অপরিহার্য । কিন্তু সরকারি মাধ্যমিক সৃষ্টি হয় না। সরকারি – বেসরকারি কলেজ এবং বেসরকারি মাধ্যমিক এ আইসিটি শিক্ষকের কিন্তু আছে।

কেন?

৫। ডাবল শিফট মানে পরিপূর্ন দুইটি স্কুল। প্রধান শিক্ষকগণ ১৫০০ ( পনের শত ) টাকা ডাবল শিফট ভাতা পান।
স্কেল বাড়লেও গ্রেড চেঞ্জ হলেও এমনকি জাতীয় বেতন স্কেল পরিবর্তন হলেও এটি ১৫০০ টাকাই থাকে ।

একই মন্ত্রণালয়ের কারিগরি অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান গুলোর সেকেন্ড শিফট ভাতা ৩০%!

৬। পদের সাথে আমাদের বিষয়ের মিল নেই। আমাদের মাধ্যমিক এ ইংরেজি শিক্ষক এর শূন্যপদে বাংলার শিক্ষক বদলি হয়ে আসতে পারে। রসায়ন পদার্থের মত পদে সমাজ বিজ্ঞান শিক্ষক আসতে পারে। বেসরকারি মাধ্যমিক এবং সরকারি বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিকে কখনোই এক বিষয়ের পদে অন্য বিষয়ের শিক্ষক পদায়ন হয় না।

৭। আমাদের সরকারি মাধ্যমিকে প্রায় সকল শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ে। আমাদের প্রতি শিফট এ দুটো করে শাখা। ভৌত বিজ্ঞান নামীয় দুটো করে পদ আছে পদার্থ এবং রসায়ন পড়ানোর জন্য। এই দুটো পদে দুজন শিক্ষক প্রায়ই থাকেন না। অন্য বিষয় শিক্ষক দিয়ে পূরণ করা থাকে প্রায়ই। একজন করেও যদি থাকেন তার উপর থাকে প্রচুর ক্লাস এবং খাতার বোঝা।

আমাদের রুটিন করতে অনেক কষ্ট হয় বিষয় শিক্ষকের গরমিলের কারণে। অথচ উচ্চমাধ্যমিকে এরকম হয়না।

৮। প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে শত শিক্ষার্থী নিয়ে আমাদের শিক্ষকরা ক্লাস করেন অথচ বেসরকারি মাধ্যমিক এবং সরকারি-বেসরকারি উচ্চমাধ্যমিকে ল্যাব এসিস্ট্যান্ট সাহায্য করেন। আমাদের ল্যাব এসিস্ট্যান্ট থাকলে কি এমন ক্ষতি হবে?

৯। আমাদের মাধ্যমিকের শিক্ষকদের পদসোপান ,প্রমোশন ,টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড , কিছুই উচ্চ মাধ্যমিকের মতন নয়। অথচ একই অধিদপ্তর!

Share this post

scroll to top