সালাতুল জুমা মুসলিম উম্মাহর সাপ্তাহিক এক মহামিলন কেন্দ্র। জুমার খুতবার মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্ক যেমন মজবুত হয় তেমনি আত্মিক উন্নয়নও সাধিত হয়। এ দিনকে বলা হয় ‘ইয়াওমুল জুমা’। আল্লাহ তালার কাছে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ দিন এটি। কোরআন-সুন্নাহর বর্ণনায়ও ওঠে এসেছে জুমার দিনের অপরিসীম গুরুত্ব ও তাৎপর্য। তবে কেমন ছিল ইসলামের প্রথম জুমার প্রথম খুতবা। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) মদিনায় প্রথম জুমা পড়েছেন। তিনি নিজেই খুতবা দিয়েছেন সেদিন।
চলুন জেনে নেয়া যাক কেমন ছিল ইসলামের প্রথম জুমার প্রথম খুতবা-
দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ধরে সীমাহীন ব্যাকুলতা নিয়ে মদিনাবাসী অপেক্ষা করছে মহানবী (সা.)-এর জন্য। মহানবী (সা.)-এর মদিনা প্রবেশের খবর মদিনায় ছড়িয়ে পড়ার পর সাজ সাজ রব পড়ে গেল মদিনার ঘরে ঘরে মহানবী (সা.)-কে স্বাগত জানানোর জন্য।
সেদিন ছিল প্রথম হিজরির শুক্রবার। মহানবী (সা.) কুবা পল্লী থেকে মদিনা যাত্রা করলেন। তার সামনে-পেছনে ডানে-বাঁয়ে মুসলিম জনতার সারিবদ্ধ মিছিল। মহানবী (সা.) বনে সালেম গোত্রের কাছে পৌঁছলেন, তখন জুমার নামাজের সময় হলো। ইসলামের প্রথম জুমার নামাজ এটাই। মহানবী (সা.) জুমার নামাজে যে খুতবা দিলেন, সেটা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম খুতবা। সে ঐতিহাসিক খুতবায় মহানবী (সা.) বলেন-
‘সব মহিমা-গরিমা একমাত্র আল্লাহর। তার মহিমা প্রকাশ করি, তারই সাহায্য প্রার্থনা করি, তারই কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করি এবং সৎপথ চেনার শক্তি তার কাছে চাই। তার ওপর ঈমান আনব এবং তার আদেশ অমান্য করব না। যে তার বিদ্রোহী তাকে আপনার বলে মনে করব না।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ইলাহ নেই এবং এটাও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ তার বান্দা ও প্রেরিত রাসূল। যখন দীর্ঘকাল পর্যন্ত পৃথিবী রাসূলের উপদেশ থেকে বঞ্চিত ছিল, যখন জ্ঞান পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, যখন মানবজাতি ভ্রষ্টতা ও অনাচারে জর্জরিত, তাদের মৃত্যু ও কঠোর কর্মফল ভোগের সময় যখন নিকটবর্তী হয়ে আসছিল, এমন সময় আল্লাহ তার রাসূলকে সত্যের আলো ও জ্ঞান দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে পাঠিয়েছেন।
আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুগত হয়ে চললেই মানবজীবনের চরম সফলতা লাভ হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্য হলে ভ্রষ্ট, পতিত ও পথহারা হয়ে পড়তে হবে।
সবাই নিজেকে এমনভাবে গঠিত ও সংশোধিত করে নাও, যেন পাপজনিত কাজের প্রবৃত্তিই তোমাদের হৃদয় থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তোমাদের প্রতি এটা আমার পরম উপদেশ। পরকাল চিন্তা ও তাকওয়া অবলম্বন করার চেয়ে উত্কৃষ্ট উপদেশ এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে দিতে পারে না। যেসব দুষ্কর্ম থেকে আল্লাহ তোমাদের বিরত থাকতে আদেশ করেছেন, সেগুলোর কাছেও যেয়ো না, সাবধান! এটাই হচ্ছে উত্কৃষ্ট উপদেশ, এটা শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান।
আল্লাহ সম্পর্কে তোমার কর্তব্য আছে। তার সঙ্গে তোমার যে সম্পর্ক আছে, তুমি তা ভুলে যেয়ো না। সে ব্যাপারে যেখানে ত্রুটি ঘটে যায়, তুমি প্রকাশ্যে ও গোপনে তার সংশোধন করো, তোমার সে সম্পর্ককে তুমি দৃঢ় ও নিখুঁত করে নাও- এই হচ্ছে জ্ঞান ও পরজীবনের চরম সম্বল।
স্মরণ রেখো, এর ব্যতিক্রম হলে তোমরা কর্মফলের সম্মুখীন হতে ভীত হলেও তার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই। আল্লাহ প্রেমময় ও দয়াময়। তাই এই কর্মফলের অপরিহার্য পরিণামের কথা আগে থেকেই তোমাদের জানিয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের কথা সত্যে পরিণত করবে, নিজের প্রতিজ্ঞা পালন করবে, তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আমার বাক্যের রদবদল নেই এবং মানুষের প্রতি অত্যাচারীও নই।’
অতএব, তোমরা মুখ্য-গৌণ, প্রকাশ্য-গুপ্ত সব বিষয়েই তাকওয়ার সন্ধান করো। তাকওয়াই পরম সম্পদ, তাকওয়াতেই মানবতার চরম সাফল্য। সংগত ও সংযতভাবে পৃথিবীর সব সুখ উপভোগ করো, তিনি তোমাদের তার কিতাব দিয়েছেন, তার পথ দেখিয়েছেন। এখন কে প্রকৃতপক্ষে সত্যের সেবক আর কে শুধু মূর্খের দাবিসর্বস্ব মিথ্যাবাদী—তা জানা যাবে। অতএব, আল্লাহ যেমন তোমাদের মঙ্গল করেছেন, তোমরাও সেরূপ আল্লাহর মঙ্গল সাধনে প্রবৃত্ত হও, আল্লাহর শত্রু পাপাচারীদের শত্রু বলে জ্ঞান করো এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করো। কেননা নিজের কর্মফলে ও প্রকৃতির অপরিহার্য বিধানে যার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী, সে সত্য, ন্যায় ও যুক্তি মতে ধ্বংস হোক। আর যে জীবন লাভ করবে, সে সত্য, ন্যায় ও যুক্তি সহায়তায় জীবন লাভ করুক। নিশ্চয়ই জেনো, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই।
অতএব, সদাসর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করো, আর পরকালের জন্য সম্পদ সঞ্চয় করে নাও। আল্লাহর সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক কী-এ যদি তুমি বুঝতে পারো, বুঝে নিয়ে তা দৃঢ় ও নিখুঁত করে নিয়ে নাও। তাকে ভালোবেসে বিশ্বাস করে তার ওপর আত্মনির্ভর হও। তাহলে তোমার প্রতি মানুষের যে ব্যবহার তার ভার তিনিই বহন করবেন। কারণ মানুষের ওপর আল্লাহরই কর্তৃত্ব প্রচলিত হয়। আল্লাহর ওপর মানুষের হুকুম চলে না। মানুষ তার প্রভু নয়, কিন্তু তিনি তাদের প্রভু। আল্লাহু আকবার, সেই মহিমান্বিত আল্লাহ ছাড়া আর কারো হাতে কোনো শক্তি নেই।’ (সূত্র : আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৩/২১৩)