নাজুক অবস্থায় আমিরাত ও সৌদি শ্রমবাজার

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) শ্রমবাজার সরেজমিন দেখার জন্য সফরে যাচ্ছেন। আজ শনিবার সকালে তার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করার কথা। প্রতিমন্ত্রী যে সময় সফরে যাচ্ছেন, ওই সময়টাতে সৌদি আরব ও ইউএইর শ্রমবাজারের অবস্থা খুবই নাজুক।

জনশক্তি রফতানিকারক ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবের শ্রমবাজার খোলা থাকলেও বেশির ভাগ কর্মী যাওয়ার পর ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে যাওয়ার পরও চুক্তি মোতাবেক আকামা পাচ্ছেন না। এসব জটিলতার কারণে অনেক কর্মী ইতোমধ্যে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশটির বিভিন্ন কারাগারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। দেশটিতে শুধু পুরুষ শ্রমিক গিয়ে বিপদে আছেন তা কিন্তু নয়, নারী শ্রমিক যাওয়ার পর নিয়োগকর্তাদের হাতে প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে দেশে ফেরা নারীকর্মীরা অভিযোগ করছেন। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দেশে ফিরে আসার জন্য ‘নাটকও’ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ দিকে সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক যাওয়া অব্যাহত থাকলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার গত ৬টি বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে পুরুষকর্মী নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা শুধু নারীকর্মী নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তবে সেটিও খুব কম।

গতকাল শুক্রবার বিকেলের পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর সাথে তার ইউএই সফরে যাওয়ার বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি টেলিফোন ধরেননি। পরে সফরের বিষয়টি নিশ্চিত হতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামানকে টেলিফোন করলে তিনিও ফোন ধরেননি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আহাম্মদ মনিরুছ সালেহিন ছাড়াও একজন ডিএসসহ ৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল রয়েছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমদ চৌধুরী নোমান এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, ইউএই-এর শ্রমবাজার অনেক দিন ধরেই বন্ধ। এই বাজারটি খুলতে মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেবে এমনটি আশা করছে বায়রা। তিনি বলেন, বাজারটি খুলতে যদি কোনো বাধা থাকে সেটি মন্ত্রী সরেজমিন দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি যতটুকু জেনেছি মন্ত্রী যাচ্ছেন দুবাইয়ে বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে আলোচনা করতে, দূতাবাসের কার্যক্রমে কোনো সমস্যা আছে কি না সেটি সরেজমিন দেখতে। সৌদি শ্রমবাজারের দুরবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৌদি বাজারে তো লোক যাচ্ছে। তবে এখানে লোক যাওয়ার পর বিভিন্ন সময় কর্মীর আকামা পাওয়া যাচ্ছে না। রয়েছে মোসানেদ জটিলতা। এসব সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদের যাওয়ার পর যেনো নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় সেই পদক্ষেপ নেবেন তিনি।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি প্রেরণ করা হয়েছে ৫৯ হাজার ৩৭ জন। এরমধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ৩০ হাজার ১৫১ জন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন মাত্র ৩৬৩ জন। মালয়েশিয়ায় ২১ জন, ইরাকে ২ হাজার ২২২জন, ওমানে ৮ হাজার ৩২৭ জন এবং কাতারে ৭ হাজার ৮৭১ জন। নারী শ্রমিক গেছেন ১১ হাজার ৬০৩ জন। তার মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ৭ হাজার ৮৮৩ জন। একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নারী শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছেন মাত্র ২৯৯ জন। অপরদিকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ থেকে কর্মী গিয়েছিল ৮১ হাজার ৮৪৬ জন; সে তুলনায় এ বছর প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কম। একইভাবে অন্যান্য দেশেও কর্মী যাওয়ার হার তুলনামূলক কমেছে।

বৃহস্পতিবার রাতে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর সাথে যোগাযোগ করে সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের অবস্থা নাজুক এবং শ্রমিকরা নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, শুধু সৌদি আরব নয়, পুরো মিডলইস্টের অর্থনৈতিক অবস্থায় মন্দাভাব বিরাজ করছে। শ্রমিকদের রিটার্ন আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রিটার্ন যাচ্ছে এটা কিন্তু ঠিক নয়, যেসব দেশ সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল সেগুলোতে একদিকে মন্দাভাব থাকলেও অপরদিকে আবার ভালোও হচ্ছে। প্রচুর শ্রমিক আবার আসছেও। আমরা যদি ঠিক মতো প্লান করি, তাহলে আমাদের দেশ থেকেও শ্রমিক আসতে থাকবে বেশি বেশি করে। এমনটাই আশা করি সবসময়। শ্রমিক প্রেরণে অভিবাসন ব্যয় সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমরা বড় বড় কোম্পানিকে ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছি। তারাও আমাদের কথা মতো কোম্পানি বøাকলিস্ট করছে। এসবের কারণেই অভিবাসন রেট কমে এসেছে। এখন আমাদের এটা মেইনটেন করতে হবে। যাতে রেটটা আবার বেড়ে না যায়। রাষ্ট্রদূত বলেন, আমাদের তো ম্যানপাওয়ার সেক্টরে কাজ করা মানে ভেরি টাফ ব্যাপার ? তারপরও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাÑ যেভাবে হোক, যত কম টাকায় হোক, পারলে বিনা পয়সায় কর্মী নিয়ে যাও। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা মোতাবেক চেষ্টা করে যাচ্ছি। শ্রমবাজারে কর্মীর সংখ্যা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা মার্কেটিং করতেছি। সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা মন্দা। তেলের দাম কমলে যা হয় আর কি।

এর আগে সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে পুরান ঢাকার বাসিন্দা মো: সান মিয়া টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে শ্রমবাজারের অবস্থা জানিয়ে বলেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশীদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। কোম্পানি নেই, তারপরও ওই কোম্পানির নামে কর্মী আসছে। কিছু দিন আগে আল ফাহাদ নামের বড় একটি কোম্পানির নামে বাংলাদেশ থেকে দেড় শ’ শ্রমিক এসেছে। কিন্তু কোম্পানি বন্ধ থাকায় দালালদের মাধ্যমে তাদের জিজান শহরের অন্য একটি কোম্পানিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনেক কোম্পানি ঠিকমতো কর্মীদের বেতন না দেয়ায় অনেকেই পালিয়ে চলে যাচ্ছে অন্যত্র। পরে পুলিশের হাতে তাদের অনেকে ধরা পড়ছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। তবে তিনি যে সরকারি মিউনিসিপ্যাল কোম্পানিতে কাজ করছেন সেখানেও তিন মাস তাকে সমস্যায় কাটাতে হয়েছিল। এখন তিনি ১৫০০ রিয়াল মাসিক বেতন পাচ্ছেন। তবে ওভারটাইম নেই।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top