ময়মনসিংহে সাকার মাছের দ্রুত বিস্তারে বিপর্যয়ের মুখে মৎসশিল্প

পুরো নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। অনেকে সাকার ফিশ নামে চেনে। বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস। অ্যাকুরিয়ামে চাষযোগ্য বিদেশি প্রজাতির এই ক্ষতিকর মাছটি এখন হর হামেশাই দেখা যাচ্ছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন নদ-নদী, হাওর ও জলাশয়ে। নদ-নদী, পুকুর ও হাওড়ে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্প্রতি এই মাছটি দেখা যাচ্ছে বেশি। এই মাছ জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ায় দেশীয়ভাবে উৎপন্ন মাছগুলোকে শেষ করে দিচ্ছে। এর ব্যাপক বিস্তার ঘটলে দেশের মৎস খাত হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন মৎস্য গবেষকরা। বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রজাতির সাকার ফিশ ১৬-১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হলেও মাছটি পানি ছাড়াই প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মৎস্য আইন ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতি সাধন হয় এমন যে কোন বিদেশি মাছ চাষ দণ্ডনীয় অপরাধ।

অ্যাকুরিয়ামের শোভাবর্ধক এই মাছটি ময়মনসিংহ অঞ্চলের উন্মুক্ত পরিবেশ পেয়ে আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। দ্রুত বংশবিস্তার ও প্রচুর খাদ্য গ্রহণের কারণে জলাশয়ের মাছসহ অন্যান্য প্রাণী হুমকির মুখে পড়ছে। ইতোমধ্যে এই মাছের কারণে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে মিয়ানমার ও আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশ। তবে দেশে দ্রুত বংশ বিস্তারকারী মাছটি কিভাবে জলাশয়গুলোতে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার সঠিক তথ্য দিতে পারছে না কেউই। তবে দেশের মৎস খাতকে ধ্বংস করতে এই মাছটি দেশের প্রত্যন্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে কোন চক্র জড়িত কিনা তা নিয়ে এখনও কারও মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু এরই মধ্যে জলাশয়ের মাছ চাষীদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মাছ।

সাকার মাছের পরিচিতি মূলত শহুরে লোকের কাছে। বাড়িতে বা অফিসে রাখা অ্যাকুরিয়ামে রংবেরং এর মাছের মধ্যে কালো শরীরে হলুদ ছোপের এই মাছ দেখা যায় প্রায়ই। অনেকে এই মাছটিকে চেনেন অ্যাকুয়ারিয়ামে মাছের ময়লা খেকো মাছ হিসেবে, কারণ শোভা বর্ধনের পাশাপাশি মাছের বর্জ্য এবং অ্যাকুরিয়ামের অন্যান্য ময়লা খেয়ে ফেলে এই মাছ। অনেকে শুরুর দিকে অ্যাকুরিয়াম ফিশ হিসেবে পালন করলেও পরবর্তীতে মাছটি বড় হয়ে গেলে তখন পুকুর বা ডোবায় ছেড়ে দেয়। সেখানে মাছটি নতুন পরিবেশে খাপ খেয়ে বংশ বিস্তার শুরু করে। মাছটি খেতে সুস্বাদু না হওয়ায় সাধারণত কেউ মাছটি খায় না এবং বাজারেও মাছটির কোনো চাহিদা নেই।

ময়মনসিংহ লাইভ এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশের শতকরা ২২ ভাগ মাছ উৎপাদন হয় ময়মনসিংহ জেলায়। কিন্তু কয়েকমাস ধরে অসংখ্য হারে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জসহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) জলাশয়গুলোতে এই মাছটি পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি ময়মনসিংহে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফিসারিতেও দেখা গেছে এই ক্ষতিকর মাছ। ময়মনসিংহের অনেকই জানিয়েছেন, আগে সবসময় নদী থেকে দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছ পাওয়া গেলেও এবার বেশি করে ‘অপরিচিত’ এসব ভয়ংকর ক্যাট ফিশ উঠছে অনেকের জালে।

তথ্যমতে, এই মাছটি একবার কোনো জলাশয়ে ঢুকে পড়লে এর বিস্তার রোধ করা খুব কঠিন। চাষের পুকুরে এই মাছ ঢুকে পড়লে অন্য মাছের সাথে খাবার ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। এতে করে বাইরে থেকে পর্যাপ্ত খাবার প্রদান করলেও কাঙ্ক্ষিত মাছের উৎপাদন পাওয়া যায় না। সাকার ফিশ জলজ পোকামাকড় ও শেওলার পাশাপাশি ছোট মাছ এবং মাছের পোনা খেয়ে থাকে। তাছাড়া সাকার ফিশের পাখনা খুব ধারালো। মাছের সাথে লড়াই করার সময় ধারালো পাখনার আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহে ক্ষত তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে পচন ধরে সেগুলো মারা যায়। সাকার ফিশ রাক্ষুসে প্রজাতির না হলেও প্রচুর পরিমাণে খাবার ভক্ষণ করে। এতে খাদ্যের যোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি হয় অন্য মাছের সাথে। বেশিরভাগ সময়ই দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে জলাশয় থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া একটি জরিপে দেখা যায়, ময়মনসিংহে অহরহ পাওয়া যাচ্ছে এই ক্ষতিকর মাছটি। শেরপুরের নকলার আনোয়ারুল হক জানিয়েছেন, তার পুকুরে এই মাছটি প্রচুর পরিমানে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও মৎস চাষী আজিজুল হক জানান, দুই বছর ধরে পুকুরে বিষ দিয়েও এই মাছ নিধন করতে পারছেন না।

জিওগ্রাফি অ্যান্ড ইউ ডটকম থেকে জানা গেছে, মিঠাপানির এই মাছটির আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। বিশেষত ব্রাজিলে অ্যামাজন অববাহিকায় এই মাছ প্রচুর পাওয়া যায়। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম টেরিগোপ্তিকথিস। মাছটির শরীর অনেক খসখসে ও ধারালো। এর পাখনাগুলোও অনেক ধারালো। ১৬-১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হওয়া এই মাছ প্রচুর পরিমাণে খাবার খায়। বিশেষত জলাশয়ের সব শ্যাওলা খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এ ছাড়া চিংড়ি ও ছোট শামুক জাতীয় শক্ত খোলের প্রাণী খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। এরা খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে অন্যান্য মাছের আবাসস্থল দখল করে ফেলে। মাছটি পানি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে। এদের মধ্যে লাফানোর প্রবণতা থাকায় তারা এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এই মাছের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে মিয়ানমার টাইমস জানিয়েছে, এই মাছ প্রচুর খাদ্য গ্রহণের কারণে জলাশয়ের অন্যান্য মাছ খাদ্য সংকটে পড়ে। এ ছাড়া এই মাছের আঘাতে অন্য মাছের শরীরে ঘা ও ইনফেকশন হয়ে যায়। আক্রান্ত মাছগুলো খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে মাছগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, একপর্যায়ে সেগুলো মারা যায়। ফলে সাকার ফিশের উপদ্রবে অনেক মৎস্য খামারি পথে বসেছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে চীন থেকে বিশেষজ্ঞ দলও এনেছিল মিয়ানমার, কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ড. মো. খলিলুর রহমান বাংলাদেশে এই মাছের বিস্তার বিষয়ে ময়মনসিংহ লাইভকে বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ক্যাটফিশের দ্রুত বংশবিস্তারের জন্য অনূকূলে থাকায় জলাশয়ের দেশীয় মাছগুলো এখন হুমকির মুখে পড়ছে। এটি ক্যাটফিশ জাতের হওয়ায় জলাশয়ের একেবারে নিচের স্তরে থাকে, ফলে এই মাছটি খুঁজে খুঁজে সরিয়ে ফেলার কাজটি খুবই কঠিন। এই মাছটির বডি স্ট্রাকটার দেখে মনে হয়, এই মাছটি শুকনা স্থানেও প্রায় ২৪ ঘন্টা বেঁচে থাকতে পারে। এই মাছটির নিধন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে শীঘ্রই দেশের মৎসখাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এই ক্ষতিকর মাছটি দেশে যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে তা হচ্ছে বায়োলজিক্যাল ক্রাইম।

তবে তিনি জেনেছেন, ২০০২ সালে এই মাছটি প্রথম এই দেশে আনেন একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক। ওই কূটনৈতিক নিজের অ্যাকুয়ারিয়ামের জন্য মাছটি এনেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় সেই মাছগুলো গুলশান লেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বর্তমানে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন স্থানে এই মাছ পাওয়ার খবর দিচ্ছেন জেলেরা। তবে এ মাছটি সারাদেশে কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল তা নিয়ে এখনও গবেষণা হয়নি বলেও জানান তিনি।

এদিকে মৎস চাষীদের মতে, শীঘ্রই এই মাছ নিধনের ব্যবস্থা করা না গেলে রেণু পোনা থেকে শুরু করে বড় মাছের উৎপান অনেকাংশে কমে যেতে পারে। ফলে হুমকির মুখে পড়বে দেশের মৎস শিল্প।

[visual-link-preview encoded=”eyJ0eXBlIjoiZXh0ZXJuYWwiLCJwb3N0IjowLCJwb3N0X2xhYmVsIjoiIiwidXJsIjoiaHR0cHM6Ly93d3cuZmFjZWJvb2suY29tL015bWVuc2luZ2hsaXZlL3Bvc3RzLzEzNDk4Mjc4MDIwNzk2ODciLCJpbWFnZV9pZCI6ODY3NzUsImltYWdlX3VybCI6Imh0dHBzOi8vbXltZW5zaW5naGxpdmUuY29tL3dwLWNvbnRlbnQvdXBsb2Fkcy8yMDIxLzA3L1Nha2FyLUZpc2gucG5nIiwidGl0bGUiOiLgpqvgp4fgprjgpqzgp4HgppXgp4cg4KaV4KeN4Ka34Kak4Ka/4KaV4KawIOCmuOCmvuCmleCmvuCmsCDgpqvgpr/gprbgp4fgprAg4Kao4Ka/4KaJ4Kac4Kaf4Ka/IOCmuOCmsOCmvuCmuOCmsOCmvyDgpqbgp4fgppbgpqTgp4cg4KaP4KaW4Ka+4Kao4KeHIOCmleCnjeCmsuCmv+CmlSDgppXgprDgp4HgpqgiLCJzdW1tYXJ5Ijoi4KaP4KaHIOCmruCmvuCmmyDgppzgprLgpr7gprbgp5/gp4cg4Kab4Kec4Ka/4Kef4KeHIOCmquCnnOCmvuCnnyDgpqbgp4fgprbgp4Dgp5/gpq3gpr7gpqzgp4cg4KaJ4KeO4Kaq4Kao4KeN4KaoIOCmruCmvuCmm+Cml+CngeCmsuCni+CmleCnhyDgprbgp4fgprcg4KaV4Kaw4KeHIOCmpuCmv+CmmuCnjeCmm+Cnh+ClpCDgpo/gprAg4Kas4KeN4Kav4Ka+4Kaq4KaVIOCmrOCmv+CmuOCnjeCmpOCmvuCmsCDgppjgpp/gprLgp4cg4Kam4KeH4Ka24KeH4KawIOCmruCnjuCmuCDgppbgpr7gpqQg4Ka54KeB4Kau4KaV4Ka/4KawIOCmruCngeCmluCnhyDgpqrgpqHgprzgpqzgp4cg4Kas4Kay4KeHIOCmhuCmtuCmmeCnjeCmleCmviDgppXgprDgppvgp4fgpqgg4Kau4KeO4Ka44KeN4KavIOCml+CmrOCnh+Cmt+CmleCmsOCmvuClpCIsInRlbXBsYXRlIjoiY29tcGFjdCJ9″]

 

Share this post

scroll to top