পথে সীমাহীন ভোগান্তি

ঈদ উপলক্ষ্যে গ্রাম ও মফস্বল শহরে যাওয় মানুষেরা শুক্রবার লকডাউন শুরুর আগেই ঢাকা পৌঁছতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ঈদের দিন (বুধবার) বিকাল কিংবা সন্ধ্যায় আবার কেউ পরদিন (বৃহস্পতিবার) কর্মস্থল রাজধানী বা আশপাশের জেলাগুলোর উদ্দেশে রওয়ানা দেন। এ কারণে ট্রেন, লঞ্চ ও সড়কপথে প্রচণ্ড যাত্রী চাপ ছিল।

বরিশাল থেকে ঢাকাগামী প্রতিটি লঞ্চে ছিল উপচে পড়া ভিড়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকামুখী মানুষের চাপ ছিল শিমুলিয়া (মুন্সীগঞ্জ)-বাংলাবাজার (মাদারীপুর) এবং দৌলতদিয়া- পাটুরিয়া নৌরুটে। বৃহস্পতিবার সব যান পারাপার সম্ভব না হওয়া শুক্রবার সকাল পর্যন্ত শত শত যান আটকা ছিল দুই নৌ রুটের ফেরিঘাটে।

পরে লকডাউনের মধ্যেই এগুলোকে পার করে দিতে হয় সংশ্লিষ্টদের। তবে ওইসব যানের অধিকাংশই রাজধানীতে প্রবেশ করতে পারেনি। প্রবেশমুখেই সেগুলো থামিয়ে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে যাত্রীরা হেঁটে রাজধানীতে প্রবেশ করেন। লঞ্চ এবং ট্রেনে রাতে আসা যাত্রীরাও একই বিপদে পড়েন। ঢাকা সদরঘাট থেকে মনুষ দলে দলে হেঁটে গন্তব্যে রওয়ানা দেন।

যারা রিকশা বা ভ্যান পেয়েছেন তাদের গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। এদিকে লঞ্চ, ট্রেন, বাস কিংবা ফেরি কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না। প্রত্যেক যানেই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে। অধিকাংশ যাত্রীর মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে শুক্রবার। চলবে ৫ আগস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত।

দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় ফেরা সব লঞ্চেই ছিল মানুষের ভিড়। লঞ্চের ডেক থেকে শুরু করে কেবিন, ছাদ এমনকি কেবিনের সামনের পথেও যাত্রী বহন করতে দেখা গেছে। অধিকাংশ যাত্রীর মুখে ছিল না মাস্ক। পটুয়াখালী থেকে ঢাকার উদ্দেশে বৃহস্পতিবার ৮টি লঞ্চ ছেড়ে আসে। লঞ্চগুলো পটুয়াখালী থেকে দুমকি বাউফলের বগা ও চরগরবী ঘাট থেকে যাত্রী নেওয়ার পরপরই পুরো লঞ্চ ভর্তি হয়ে যায়।

এসব লঞ্চে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। অধিকাংশ যাত্রীর মুখে মাস্ক ছিল না। শুক্রবার ভোরে অনেক লঞ্চ সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছে। লঞ্চ, সড়ক কিংবা ট্রেনে যারা শুক্রবার রাজধানীতে পৌঁছেন, তারা চরম বিপদে পড়েন। বাধ্য হয়ে জিনিসপত্র নিয়ে হেঁটে গন্তব্যে রওয়ানা দেন তারা। অনেকে ১৪-১৫ কিমি. পথ পাড়ি দেন। কেউ কেউ রিকশা কিংবা ভ্যানে গন্তব্যে যান।

মতিঝিল থেকে হেঁটে বনানী আসা পঞ্চাশোর্ধ্ব মিজান মিয়া জানান, রিকশায় ৫শ টাকা ভাড়া চেয়েছে। তাই হেঁটে বনানী এসেছেন। তবে বাড়ি থেকে বাসে ঢাকা পৌঁছেছি দ্বিগুণের বেশি ভাড়া দিয়ে। আরেক যাত্রী জানান, রিকশায় উঠলেও ঝামেলা। ভাড়া বেশি-তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে পুলিশ আটকে দেয়। তাই হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, বাড়ি যাওয়ার সময়ও এভাবেই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পর্যন্ত একই অবস্থা ছিল রেলপথে। এক সিট ফাঁকা রেখে ট্রেনের টিকিট বিক্রি হলেও অধিকাংশ ট্রেনেই তা মানা হয়নি। আন্তঃনগর থেকে মেইল ট্রেনে উপচে পড়া ভিড় ছিল। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, অধিকাংশ স্টেশন উন্মুক্ত থাকায় স্টেশনে স্টেশনে ট্রেন বিরতি দিতেই হুড়োহুড়ি করে বিনা টিকিটের যাত্রীরা ট্রেনে উঠে পড়েন।

এসব যাত্রী রোধ করার মতো জনবল ট্রেন ও স্টেশনগুলোতে ছিল না। মহানগর গোধূলি এক্সপ্রেসের যাত্রী আমিনুল ইসলাম জানান, অনলাইনে ২২ জুলাইয়ের ফিরতি টিকিট কাটতে গত ৪ দিন ধরে চেষ্ট করেছেন- কাটতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়েই মহানগর গোধূলি ট্রেনে কুমিল্লা থেকে বিনা টিকিটে ঢাকায় আসেন। ট্রেনে উঠে দেখেন তার মতো অনেকেই বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করে ঢাকায় এসেছেন।

বিআইডব্লিউটিএর বাংলাবাজার (মাদারীপুর) ঘাট সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ঢাকামুখী যাত্রীদের চাপ বাড়তে থাকে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে। রাতে আটকা পড়ে অসংখ্য যানবাহন। শুক্রবার সকালে ভিড় বাড়তে থাকে যাত্রী ও যানবাহনের। পরে প্রশাসনের কড়াকড়ি বেড়ে যাওয়ায় সকাল নয়টার পর ঘাটে নতুন করে আর কোনো যাত্রী প্রবেশ করতে পারেনি।

ফলে কমতে থাকে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ। বিআইডব্লিউটিসি বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, কঠোর বিধিনিষেধে আমরা কোনো যাত্রীকে ফেরিতে উঠতে দিচ্ছি না। সকাল (শুক্রবার) ৯টার আগেই ঘাটে যাত্রী ও আটকে থাকা যানবাহন পারাপার হয়ে গেছে।

এখন পণ্যবাহী ট্রাক, লাশবাহী গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স আমরা ফেরিতে পারাপার করছি। কোনো যানবাহন এখন অপেক্ষমাণ নেই। ঘাট অনেকটাই ফাঁকা।’ তিনি বলেন, ‘তীব্র স্রোতের কারণে ফেরি চলাচলে কিছুটা বাধা সৃষ্টি হলেও আমরা ১৬টি ফেরি চালু রেখেছি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি বা যাত্রী পারাপার করা হবে না।

এদিকে শুক্রবার ভোরে সাধারণ যাত্রী এবং বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের চাপ ছিল রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে। বিশেষ করে ছোট বা ব্যক্তিগত গাড়ি লম্বা লাইন দিয়ে ফেরিতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে দূরপাল্লার পরিবহণের সঙ্গে পণ্যবাহী গাড়ির লম্বা লাইন দেখা গেছে।

আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে আসা বিভিন্ন ধরনের দুই শতাধিক গাড়ি ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। বিকল্প সড়কের ৫ নম্বর ফেরিঘাটের মাথায়ও ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায় ছিল শত শত গাড়ি।

বিপরীত দিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট থেকে শুক্রবার সকালে ছেড়ে আসা প্রতিটি ফেরিতেও বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সঙ্গে শত শত যাত্রী পার হতে দেখা গেছে। এখানেও স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই ছিল না।

Share this post

scroll to top