বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এবার সেশনজটের ধকল পোহাতে হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। প্রায় ১৬ মাস বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা হয়নি। এসএসসি-এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাগুলো শুধু বন্ধই নয়, একটির পেছনে আরেকটি হাজির হওয়ার পথে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষাগুলোর তারিখ পুনর্নির্ধারণও করা যাচ্ছে না। কবে নাগাদ এগুলো নেওয়া যাবে সেটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। গণসাক্ষরতা অভিযানের (ক্যাম্পে) উপ-পরিচালক কেএম এনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, করোনার দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা পরিমাপ করে বোঝানো যাবে না। পরীক্ষাগুলো আটকে আছে। ঠিকমতো শ্রেণি কাজ হয়নি।
যদিও সরকারি লোকজনের কথায় মনে হতে পারে অনলাইনে শতভাগ শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। করোনায় শিক্ষার ক্ষতি পূরণে সরকার ইতোমধ্যে ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্ল্যান’ নামে একটি দলিল তৈরি করেছে। এর আলোকে কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী শিখন ঘাটতি পূরণে কাজ করতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট সৃষ্টি হয়ে থাকে। আগের বছরের পরীক্ষা না হওয়ায় পরের বছরের পরীক্ষা আটকে যায়। এভাবে চলতে চলতে সৃষ্টি হয় সেশনজট। করোনার কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবার স্কুল-কলেজে।
চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল যথাক্রমে ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে। মহামারির ডামাডোলে সেই পরীক্ষা এখন পর্যন্ত হয়নি। যথাসময়ে পরীক্ষা দুটি নেওয়া গেলে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা এখন কলেজে ক্লাস করত। আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা অংশ নিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষায়। অন্যদিকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উল্লিখিত দুই পরীক্ষার কাজ শেষ না করলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে এ পরীক্ষা দুটি পিছিয়ে যাবে।
সে ক্ষেত্রে এ দুই স্তরে সেশনজট আরও দীর্ঘায়িত হবে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, পরিস্থিতিই আমাদের অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য করছে। তবে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার সার্বিক প্রস্তুতি আছে। এইচএসসিও নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থার কারণে স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, পরীক্ষা কবে নাগাদ নেওয়া যাবে সেটিরই নিশ্চয়তা নেই। এখন পর্যন্ত সরকারের চিন্তা হলো, ‘কাস্টমাইজড’ সিলেবাসের ভিত্তিতে ক্লাস শেষে পরীক্ষা নেওয়া হবে।
পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে বিকল্প পন্থা নেওয়া হতে পারে। সেটি হচ্ছে, সিলেবাসের ওপর মূল্যায়ন করা। যেহেতু আগামী ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি এসএসসি পরীক্ষা নিতে হবে তাই ডিসেম্বরের মধ্যে এবারের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার কাজ শেষ করতে হবে। শিগগিরই বিকল্প পন্থা অবহিত করার লক্ষ্যে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংবাদ সম্মেলনে আসবেন।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা জানান, বিদ্যমান ছাত্রছাত্রীদের সেশন পেছালেও তাদের কম-বেশি লেখাপড়া চলছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে প্রাক-প্রাথমিক বা প্লে, নার্সারি ও কেজি বা শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। এ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দুই বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা স্তর চালু করা হয়।
পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে ভর্তির বয়স আরও এক বছর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ৪ বছর বয়সি শিশুরা পারবে ভর্তি হতে। এর ফলে অন্তত ৬০ লাখ শিশু ভর্তি উপযোগী বলে জানা গেছে। এসব শিশুর প্রায় সবই ভর্তিবঞ্চিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জীবনের শুরুতেই তারা সেশনজটে পড়ে গেল। অনেকটা ঘরবন্দি ও লেখাপড়াবিহীন জীবন কাটছে তাদের। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর প্রায় ৩৭ লাখ শিশু প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হয়।
গত ১৬ মাসে স্কুল ও কলেজে একটি পরীক্ষাও নেওয়া যায়নি। গত বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। এবারের এ দুই পরীক্ষাও বাতিলের চিন্তাভাবনা চলছে। সাধারণত নভেম্বরে এ পরীক্ষা দুটি হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এ দুই স্তরের সেশনজট দূর করার লক্ষ্যে গত বছর পরীক্ষা না নিয়ে পরের শ্রেণিতে অটোপাশ দিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে।
করোনা শুরুর আগে নেওয়া হয়েছিল গত বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। যে কারণে শিক্ষার্থীদের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ঘরে বসেই তাদের বছরটি পার হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত তারা দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠার বার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারেনি। আর গত বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল করে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় ‘অটোপাশ’।
একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল স্কুল-কলেজের অভ্যন্তরীণ সব পরীক্ষার ক্ষেত্রে। প্রাথমিক স্তরের প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক এবং বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এ ক্ষেত্রে ষষ্ঠ, সপ্তম, নবম শ্রেণিতে অটোপাশ দেওয়া হয়।
পিইসি উত্তীর্ণরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও মাধ্যমিকের কোনো স্বাদ পায়নি এখনও। এসএসসি পরীক্ষা না হওয়ায় বর্তমানে দশম শ্রেণিতে দুটি ব্যাচ আছে। এবারে যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে তারাও অটোপাশে উঠেছে দ্বাদশ শ্রেণিতে। তাদের এইচএসসির টেস্টও বাতিল করা হয়। আর এসএসসি পরীক্ষার্থীরাও দিতে পারেনি গতবছরের অর্ধবার্ষিক, প্রি-টেস্ট এবং টেস্ট পরীক্ষা। সর্বশেষ এখন পর্যন্ত স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা কোনো অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা নিতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটোপাশ দিয়ে সেশন বাঁচানো গেছে। কিন্তু এতে ছাত্রছাত্রীরা শেখার ক্ষতি থেকে বাঁচতে পারেনি। এখন সেটা থেকে বাঁচানোর পথ বের করতে হবে। আর সে জন্য কয়েক বছর মেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি কোভিড রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা দরকার।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, এবারে জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু করা যাবে- এমন আশা থেকে গত বছরে সরাসরি ক্লাসরুমে না পড়ানোর ক্ষতি পোষানোর পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু এবার কবে ক্লাস শুরু করা যাবে তা নিশ্চিত নয়। তাই কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। বারবার কোনো পরিকল্পনা করা যায় না। তাই ক্লাস কার্যক্রম চালু হলে একটি ‘পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা’ (রিকভারি প্ল্যান) তৈরি করা হবে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে ১৭ মার্চ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেই ছুটি দফায় দফায় বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ৩১ জুলাই পর্যন্ত চলবে এ ছুটি।