বিদেশেগামী কর্মীদের তিন দিনের ট্রেনিং নেয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও সারা দেশের টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে (টিটিসি) সেইভাবে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে না। কখনো কখনো টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের কতিপয় দুর্নীতিবাজকে ম্যানেজ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা ইদানীং ট্রেনিং ছাড়াই অনলাইন সার্টিফিকেট বের করে কর্মীর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অবশ্য এর আগে বিদেশে শ্রমবান্ধব বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশনের ক্লিয়ারেন্স না থাকার (অসত্যায়িত ভিসা) পরও দালালরা ঢাকায় বসে কম্পিউটারে ‘ট্রেনিং সার্টিফিকেট’ তৈরি করে জমা দিলেই বহির্গমন ছাড়পত্র সহজে পাওয়া যেত। এভাবে দেশ থেকে হাজার হাজার কর্মী সৌদি আরব, কাতার, আবুধাবি, মালয়েশিয়া, লেবানন, জর্ডান, ওমান, মালদ্বীপ, ব্রুনাইসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই এখন বেতন-ভাতার সমস্যাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত।
ট্রেনিং সার্টিফিকেট ছাড়াই বিদেশে কর্মী গিয়ে বিপদে পড়ার খবর জানাজানি হওয়ার পর সম্প্রতি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে বহির্গমন ক্লিয়ারেন্স নেয়ার আগে অনলাইনে রেকর্ড ট্রেনিং সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা জারির পর থেকেই অনিয়ম জালিয়াতি কিছুটা কমলেও এখনো নানা কৌশলে দেশের বেশ কিছু টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে কর্মীদের ট্রেনিং না দিয়ে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এই চক্রের সাথে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় অথবা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তেমন একটা নজরদারি নেই বরং সরকারের পক্ষ থেকে যত কড়াকড়ি নিয়ম করা হয় টাকার ডিমান্ড তত বেড়ে যায় বলে জানিয়েছে ভূক্তভোগী ও দায়িত্বশীল সূত্রগুলো।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে থাকা টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মনিটরিং যথাযথভাবে না হওয়ার কারণে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ট্রেনিং না করিয়েও অনেক সময় সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যেসব ট্রেনিং সেন্টারে বিদেশ যাওয়ার আগে তিন দিনের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে, ওই ট্রেনিং নিয়েও বিদেশগামীরা খুব একটা উপকার পাচ্ছেন না। তাদের মতে, ট্রেনিংয়ের সাথে যেসব অধ্যক্ষ, ইন্সট্রাকটর জড়িত রয়েছেন তাদের আরো গভীরভাবে এবং দায়িত্বশীলভাবে এ বিষয়টি মনিটরিং করতে হবে। না হলে বিদেশে গিয়ে এসব কর্মীর কপালে জুটবে শুধু বিপদ আর বিপদ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে কয়েকজনের সাথে নানা কৌশলে কথা বলার পরও তারা স্পষ্টভাবে এ প্রতিবেদককে বলেন, আগে কি হতো না হতো জানি না, তবে এখন সার্টিফিকেট পেতে হলে অবশ্যই কর্মীদের পাসপোর্ট ভিসার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। এরপর পরপর তিন দিন ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে হবে।
যদি এক দিন বাদ যায় তাহলে ওই কর্মীর নামে সার্টিফিকেট ইস্যু হবে না। তবে এরপরও ট্রেনিং সেন্টারে গড়ে ওঠা আকাশ নামের এক ব্যক্তি ট্রেনিং সেন্টারের ভেতরে বসেই এ প্রতিবেদককে বলেছেন, ট্রেনিং ছাড়া সার্টিফিকেট দেয়া যাবে, তবে এর জন্য নগদ দুই হাজার টাকা দিতে হবে। কম দিলে কাজ হবে না। রাজি থাকলে এখনই পাসপোর্ট, ডকুমেন্ট, তিন কপি ছবি আর ২০০ টাকা কাউন্টারে জমা দিয়ে ভর্তি হয়ে যান। অবশ্য ওই টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে ওই দিন বিকেলে ট্রেনিং নিয়ে বের হওয়া সৌদিগামী দুই যুবক সিএনজিযোগে তাদের বাসায় ফেরার সময় এ প্রতিবেদকের কাছে হতাশার সুরে বলেন, ‘আমরা নিয়ম রক্ষার জন্য ট্রেনিং নিচ্ছি। কিন্তু তিন দিনতো ট্রেনিং করলাম। কিন্তু তাগো কাছ থেকে তেমন কিছুই শিখতে পারলাম না। গতানুগতিক আর কি বোঝেন তো? শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া টিটিসি নয়, দেশের বেশির ভাগ ট্রেনিং সেন্টারে এমন পরিবেশ বিরাজ করছে।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রার একাধিক নেতা এ প্রতিবেদককে গতকাল বলেন, এমনিতেই অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে আমাদের যত বদনাম। তবে তিন দিনের ট্রেনিং নিয়েও যদি টিটিসিগুলো কোনো ধরনের গাফিলতি করে থাকে তাহলে অবশ্যই বিষয়টি নজরদারির মধ্যে এনে জনশক্তি ব্যুরোর দায়িত্বশীলদের খতিয়ে দেখা দরকার।
গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো: সেলিম রেজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন রিসিভ করেননি। পরে টেকনিক্য্যাল ট্রেনিং সেন্টারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে ফোন দেয়া হলে তিনিও রিসিভ করেননি।
গত রাতে বিদেশগামী একজন কর্মীর জন্য তিন দিনের ট্রেনিং ছাড়াই অনলাইন সিস্টেমে সার্টিফিকেট দেয়া যাবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসার সাথে জড়িত একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, আগে কম্পিউটারে ভুয়া ট্রেনিং সার্টিফিকেট বানিয়ে দিলেই বহির্গমন ছাড়পত্র হয়ে যেত। কর্মীরাও যেতে পারতেন। এতে এজেন্সির মালিকরা তাদের লাইসেন্সের বিপরীতে নামমাত্র টাকা দিলেই হতো। কিন্তু এখন ট্রেনিং সার্টিফিকেট অনলাইন সিস্টেমের মধ্যে চলে আসায় একটু ঝামেলা হচ্ছে। তার মতে, কড়াকড়ি হলেও সমস্যা নেই। তবে এখন ঢাকায় এসব নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সংশ্লিষ্ট জেলার টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারগুলো থেকে এই সার্টিফিকেট নিতে হচ্ছে। সেখানে কর্মীকে অফিসিয়ালি ভর্তি দেখানো হচ্ছে। তারপরও ওই টেকনিক্যাল সেন্টারের অধ্যক্ষ সই করলে সার্টিফিকেট ইস্যু হচ্ছে। সেটি অনলাইনেও দেখা যাচ্ছে। এতে অলিখিত ফিস লাগছে দুই হাজার ৫০০ টাকার মতো।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের কতিপয় ব্যক্তি টাকার বিনিময়ে ট্রেনিং সার্টিফিকেট দিচ্ছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড ট্রেনিং) ড. নুরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। যারা ট্রেনিং নিচ্ছেন তারাও কিছু শিখতে পারছেন না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি এই বিষয়েও প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলব।