হিটলারের অন্ধ সমর্থক, নাৎসি গুপ্তচর কে এই বাঙালি বধূ?

চেহারায় পুরোদস্তুর মেমসাহেব। পরিধানে একান্ত ভারতীয় পোশাক। শাড়ি পরা এই বিদেশিনি এক সময় উঠে এসেছিলেন সংবাদ শিরোনামে। ‘সাবিত্রী দেবী’ হিসেবে পরিচিত এই নারী ছিলেন এক বঙ্গসন্তানের স্ত্রী।

জন্মসূত্রে গ্রিক। আদি নাম ম্যাক্সিমিয়ানি জুলিয়া পোর্টাস। পরবর্তীকালে তিনি পরিচিতি পান ‘সাবিত্রী দেবী’ নামে। ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে হিটলারের অন্ধ ভক্ত হিসেবে। নিজেকে ‘ধর্মচ্যুত আর্য’ বলে মনে করতেন সাবিত্রী। সমর্থন করতেন নাৎসিবাদকে। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি অক্ষশক্তির গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেন মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে।

১৯০৫ সালে ফ্রান্সে লিঁও শহরে জন্ম ম্যাক্সিমিয়ানি তথা সাবিত্রী দেবীর। বাবা গ্রিক-ইটালিয়ান, মা ইংরেজ। বাল্যকালেই তার মধ্যে একটা জেদি মনোভাব লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। পশুদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে সরব হয়ে ওঠেন খুব কম বয়সেই। সেই সঙ্গে গ্রিক জাতীয়তাবাদেও তার আসক্তি দেখা দেয়।
ইউনিভার্সিটি অব লিঁও থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ম্যাক্সিমিয়ানি। পরে পিএইচডি-ও করেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই সময়েই তিনি গ্রিস ভ্রমণে যান এবং সেখানকার ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখেন।

গ্রিস ভ্রমণকালেই ম্যাক্সিমিয়ানি জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হেইনরিখ শ্লিমানের দ্বারা আবিষ্কৃত স্বস্তিকা চিহ্নের সঙ্গে পরিচিত হন। শ্লিমান প্রাচীন ট্রয়ের প্রত্নাবশেষের ১ হাজার ৮০০ জায়গায় স্বস্তিকা চিহ্ন আবিষ্কার করেছিলেন। ম্যাক্সিমিয়ানির ধারণা জন্মায়, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা আসলে আর্য সভ্যতা থেকেই জন্মেছে।

১৯২৮ সালে ম্যাক্সিমিয়ানি তার জন্মসূত্রে পাওয়া ফরাসি নাগরিকত্ব ত্যাগ করে গ্রিক নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। স্বস্তিকার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণই তাকে নাৎসিবাদের দিকে এই সময়ে আকৃষ্ট করে।

১৯২৯-এ তিনি ফিলিস্তিন ভ্রমণে যান। জিশু খ্রিস্টের স্মৃতিবিজড়িত জেরুজালেম ভ্রমণ করার সময়ে ইহুদি বিদ্বেষ তার মনে দানা বাঁধে। অন্যদিকে সেই সময়ে জার্মানিতে স্বস্তিকা চিহ্নকে সামনে রেখে হিটলার ও তার নাৎসি দল ইহুদি বিদ্বেষ ও আর্য সভ্যতার উৎকর্ষের কথা দাপিয়ে প্রচার করছেন।

১৯৩২-এ আর্য সভ্যতাকে জানতে ও বুঝতে ম্যাক্সিমিয়ানি ভারতে আসেন। আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ‘সাবিত্রী দেবী’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন। এই সময় থেকে ইহুদি-খ্রিস্টান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি সরব হন। ভারতে খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলামের প্রসারের বিরুদ্ধেও কথা বলতে শুরু করেন।

১৯৩০-এর দশক থেকেই তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন বলে জানা যায়। তার দাবি অনুযায়ী, তিনিই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপান সম্রাটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিলেন। ততদিনে অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সাবিত্রী দেবী রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষশক্তির গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছেন বলেও শোনা যায়।

১৯৪০ সালে সাবিত্রী দেবী নাৎসিবাদের সমর্থক বাঙালি বুদ্ধিজীবী অসিতকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। অসিতকৃষ্ণ সেই সময় নাৎসি জার্মানির উগ্র সমর্থক সংবাদপত্র ‘নিউ মার্কারি’-র সম্পাদক। সাবিত্রী দেবী এবং অসিতকৃষ্ণ, দু’জনেই সেই সময় অক্ষশক্তির ক্ষমতাবান সামরিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে কলকাতাতেও বাস করেছেন এই দম্পতি।

নাৎসি নেতা, জার্মানির একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারকে বিশেষ চোখে দেখতেন সাবিত্রী দেবী। হিটলার তার কাছে ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর এক অবতার। তার বহু লেখায় তিনি হিটলারকে মানব সভ্যতার রক্ষাকর্তা বলে বর্ণনা করতেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ইহুদিরা পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একমাত্র হিটলারই পারেন সেই বিপর্যয় থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৫ সালে সাবিত্রী দেবী ইউরোপ সফরে যান। ১৯৪৮ সালে তিনি জার্মানি পৌঁছেন। সেখানে তিনি নাৎসিবাদের সমর্থনে হাতে লেখা প্রচারপত্র বিলি করতে থাকেন। সেই সূত্রে মিত্রপক্ষের পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে। মিত্রবাহিনীর হাতে বন্দি নাৎসি নেতাদের মুক্তি দাবি করেই তিনি সেই সব প্রচারপত্র রচনা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত জার্মানি থেকে তাকে বিতাড়িত হতে হয়।

ছয়ের দশকে সাবিত্রী দেবী ফ্রান্সে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে তিনি শিক্ষকতা করতেন। এই সময়ে ব্রিটেনের নাৎসিবাদের সমর্থকদের সঙ্গে তার গভীর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। হিটলার-পরবর্তী বিশ্বে নাৎসিবাদকে টিকিয়ে রাখতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন।

১৯৬২-তে তিনি নয়া নাৎসি সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন অব ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টস-এর প্রতিষ্ঠাতা সচিব হিসেবে কার্যভার নেন। সেই সংগঠনের নেতা নব্য নাৎসি জর্জ লিঙ্কন রকওয়েল তার ভূমিকায় মুগ্ধ হন। নব্য নাৎসিবাদের প্রসারে সাবিত্রী দেবী নিরন্তর লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৯৭০-এ সাবিত্রী দেবী তার শিক্ষকতার কাজ থেকে অবসর নেন। ১৯৭১-এ তিনি আবার ভারতে আসেন। দিল্লিতে একাধিক বিড়াল ও একটি গোখরা সাপ নিয়ে তিনি বাস করতেন বলে জানা যায়। এখান থেকেই তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার নব্য নাৎসি নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।

এই সময়েই তিনি দাবি করেন, নাৎসিদের দ্বারা ইহুদি গণহত্যার যে বিবরণ মিত্রশক্তি বিশ্ব ইতিহাসের উপরে চাপিয়ে দিচ্ছে, তা সর্বাংশে সত্য নয়। পরবর্তীকালে এই গণহত্যাকে ‘মিথ্যা’ বলতে এগিয়ে আসেন অনেক ইতিহাসবিদ। তবে, সাবিত্রী দেবীই প্রথম এই তত্ত্ব বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন।

এমন বিতর্কিত জীবন যাপন করেও সাবিত্রী দেবী একটা বিশেষ ইতিবাচক আন্দোলনকে সমর্থন করে গেছেন আজীবন। সেটা হল পশু অধিকার আন্দোলন। ১৯৫৯ সালে তিনি ভারতে বসেই রচনা করেন ‘দি ইমপিচমেন্ট অব ম্যান’ নামে একটি গ্রন্থ। সেখানে তিনি পশু ও পরিবেশ ধ্বংসকারী হিসেবে সমগ্র মানব সভ্যতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তিনি নিজেও ছিলেন কট্টর নিরামিশাষী।

১৯৭৭ সালে স্বামী অসিতকৃষ্ণ মারা যান। সাবিত্রীও ভারতের পাট চুকিয়ে ফিরে যান ইউরোপে। কিছু দিন জার্মানির ব্যাভেরিয়ায় থাকার পরে ফিরে আসেন জন্মভূমি ফ্রান্সে। ততদিনে তিনি অথর্ব হয়ে পড়েন, প্রায় হারাতে বসেন দৃষ্টিশক্তি।

১৯৮২ সালে ৭৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সাবিত্রী দেবী মারা যান। হিন্দু রীতি মেনে তার মরদেহ দাহ করা হয়। পরে তার চিতাভস্ম ভার্জিনিয়ায় আমেরিকান নাৎসি পার্টির দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নব্য নাৎসি নেতা রকওয়েলের সমাধির পাশেই সেই ভস্মকে সমাহিত করা হয়। সূত্র: আনন্দবাজার

Share this post

scroll to top