চট্টগ্রামে অধিকাংশ কিশোর গ্যাং লিডার এখনো অধরা। অপকর্মে জড়িত কিশোর গ্যাং লিডারদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বিভিন্ন সময় অভিযান চালালেও সফল হচ্ছে খুব কম ক্ষেত্রে। নগরীর বাকলিয়া থানার খতিবের হাট এলাকায় শুক্রবার সকালে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করা ব্যক্তিরাও কিশোর গ্যাং লিডার বলে অভিযোগ উঠেছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, সরকারি দপ্তরগুলোতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, গার্মেন্ট ব্যবসা, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল কিংবা কোণঠাসা করাসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে গ্রুপিং, সংঘর্ষ ও খুনের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং লিডাররা। আর গ্রুপ ভারী করতে কিশোর তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে এরা। সিএমপির হাতে কিশোর গ্যাং লিডারদের একটি তালিকা রয়েছে। তবে এ তালিকার অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, নগরীর অপরাধপ্রবণ এলাকার শীর্ষে রয়েছে চান্দগাঁও থানা এলাকা। এখানে ভয়ংকর গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সোহেল ওরফে ফ্রুট সোহেল। তার গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য কিশোর ও দুর্ধর্ষ অপরাধী। তাদের দিয়ে সোহেল বহদ্দারহাট মোড়সহ চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ফুটপাত ও সড়কের পাশের দোকান, নির্মাণাধীন ভবন, গার্মেন্ট, আবাসিক হোটেলসহ বিভিন্ন খাত থেকে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী গ্রুপ। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং মানব পাচার আইনে চারটি মামলা হয়েছে সম্প্রতি। বেশ কিছু মামলা রয়েছে বিচারাধীন। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করার পাশাপাশি দ্বিগুণ উৎসাহে অপকর্ম করে চলেছে এই ফ্রুট সোহেল। তার সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম হলো-তার ভাই রুবেল, ধামা জুয়েল, নেওয়াজ শরীফ ওরফে কিরিচ নেওয়াজ ও পূর্ব ষোলশহর এলাকার জসিম উদ্দিন। চান্দগাঁওয়ে কিশোর জিয়াদ ও হক মার্কেটের সিকিউরিটি গার্ড সবুর হত্যাকাণ্ডের আসামিরা সবাই সোহেলের সহযোগী। এমনকি চাঁদার জন্য আমজাদ নামে এক ব্যক্তির দুই পা ড্রিল মেশিনে ছিদ্র করে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটিয়েছে সোহেলের সহযোগীরা। তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মিছিল করার জের ধরে ১ এপ্রিল পূর্ব ষোলশহর এলাকায় কুপিয়ে হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় আনোয়ার নামে এক গার্মেন্ট কর্মকর্তার। কিছুতেই সোহেল বাহিনীর ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এখানকার আরেক দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং লিডার হামকা রাজু র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। চান্দগাঁও থানা পুলিশ রহস্যজনক কারণে ভয়ংকর এ সন্ত্রাসী গ্রুপটির লাগাম টানতে পারছে না।
২০১৮ সালের এপ্রিলে স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার মধ্য দিয়ে আবিষ্কার হয় ‘রিচ কিডস’ নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব। মামলার প্রধান অভিযুক্ত আদনান মির্জা গ্রুপটির নেতৃত্বে ছিল। তাদের বড় ভাই ছিল পাঁচলাইশ এলাকার মো. ফিরোজ ওরফে ডাকাত ফিরোজ। এ মামলার এজাহারনামীয় আসামি সে, কারাগারেও যায়। বিদেশে পলাতক চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ বাহিনীর অন্যতম নিয়ন্ত্রক সে। বায়েজিদ বোস্তামী থানা ও পাঁচলাইশ থানায় তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। গত বছর চাঁদার জন্য এক প্রবাসীর ভবনে হামলা চালায় গ্রুপটি। এছাড়া ২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি প্রবর্তক মোড়ে একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্র থেকে ১১ লাখ টাকা ডাকাতি হয়। এ ঘটনার পরের দিন বায়েজিদ বোস্তামী থানায় পাঁচটি অস্ত্রসহ ফিরোজ গ্রেফতার হয়। ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই নাইনএমএম পিস্তলসহ ফের গ্রেফতার হয় ফিরোজ। ২০১৮ সালে তাসফিয়া হত্যা মামলায় এবং গত বছরের ১ মে বায়েজিদ বোস্তামী থানায় গুলি ও ইয়াবাসহ গ্রেফতারের পর দুই দফা কারাগারে যায়। বর্তমানে জামিনে এসে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ফিরোজ-এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। কালারপুল ও খতিবেরহাট এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং লিডার নাছির উদ্দিন ওরফে লম্বা নাছির। এখানে একচ্ছত্র আধিপত্য তার। বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ কিংবা মামলা করেও রেহাই পায়নি। বহাল-তবিয়তে রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাশের ফরিদের পাড়ায় প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় নুরুল আলম নামের এক যুবককে। এ ঘটনায় জড়িতরা সবাই ছিল নাছিরের গ্যাং সদস্য। এতে নেতৃত্ব দেয় ইমন ও আমজাদ নামে দুই কিশোর।
বলিরহাটের আবুর ছেলে ওসমান কিশোর গ্যাং চক্রের লিডার। শুক্রবার বাকলিয়ায় কবরস্থান দখলকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে। এতে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়। ওই ঘটনায় ভাড়াটে হিসাবে যাওয়া ওসমান নিজেই অস্ত্র চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এ ঘটনায় করা মামলায় কিশোর গ্যাং লিডার ওসমানও আসামি। তবে পুলিশ এখনো তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) শাহ মো. আবদুর রউফ যুগান্তরকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাং কালচার চট্টগ্রামে নগরীতে থাকবে না। যেসব কিশোর গ্যাং লিডারের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তারা সবাই পলাতক। তাদের খোঁজা হচ্ছে। পাওয়া গেলেই গ্রেফতার করা হবে।’