গার্মেন্ট সেক্টরে চলছে অরাজক পরিস্থিতি। একদিকে চাকরিচ্যুতি, অন্যদিকে গ্রেফতারের ভয়ে হাজার হাজার শ্রমিক এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের পরিবার-পরিজন এখন না খেয়ে থাকছে। শ্রমিকরা বলছেন, অত্যাচারের মধ্যে রয়েছেন তারা। চরম অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে তাদের। শ্রমিক নেতারা জানান, গার্মেন্ট মালিক পক্ষ ও সরকার থেকে যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল তার অধিকাংশই উল্টো হচ্ছে।
গত নভেম্বরে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর কয়েকটি গ্রেড নিয়ে আপত্তি জানিয়ে গত ৫ জানুয়ারি গার্মেন্ট শ্রমিকরা তাদের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামে। ওই দিন তারা রাজধানী উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গার্মেন্ট মালিকদের আশ্বাসের ভিত্তিতে তারা ওই দিন রাস্তা ছেড়ে দেয়। কিন্তু সেই আশ্বাস পূরণ না হলে ৬ জানুয়ারি আবারো রাস্তায় নামে তারা। উত্তরার এই আন্দোলন সাভার, টঙ্গী, গাজীপুর, আশুলিয়া এবং রাজধানীর মিরপুর, পল্লবী, শাহআলী, ভাসানটেকসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনের একপর্যায়ে গত ৮ জানুয়ারি সাভারে সুমন মিয়া নামের এক গার্মেন্ট শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হন। সেখানে আহত হয় আরো কয়েকজন। আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলিবর্ষণ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, লাঠিপেটা ও শ্রমিকদের গ্রেফতার করে। শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটায়।
শ্রমিকদের এই আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে একপর্যায়ে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। সরকার ও মালিকপক্ষের আশ্বাসের ভিত্তিতে একপর্যায়ে শ্রমিকরা ঘরে ফিরলেও তারা এখন চরম বিপাকের মধ্যে পড়েছেন বলে বেশ কয়েকজন শ্রমিক অভিযোগ করেন।
ইলিয়াস নামের এক শ্রমিক বলেন, তাকে কারখানা থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তার নামে মামলা হয়েছে। এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার অনেক সহকর্মী এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে ইলিয়াস অভিযোগ করেন। শিল্পী নামের অপর এক গার্মেন্ট শ্রমিক বলেন, স্বামী-স্ত্রী দুইজনই কাজ করে সংসার চালাতেন। তাদের এখন চাকরি নেই। নতুন চাকরি জোগাড় হওয়া পর্যন্ত হয়তো তাদের না খেয়ে থাকতে হবে।
শ্রমজীবী ও শিল্পরক্ষা আন্দোলনের সদস্যসচিব হারুনার রশিদ ভূঁইয়া গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ৪-৫ হাজার শ্রমিক এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে তার চেয়ে কয়েক গুণ অজ্ঞাত আসামি দেয়া হয়েছে। ওই অজ্ঞাতের সূত্র ধরে এখন শ্রমিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। অনেক শ্রমিক যারা হয়তো আন্দোলনে নেমেছেন তারা এখন বাসা-বাড়িতে ঘুমাতে পারেন না। তাদের চাকরি চলে গেছে, অপরদিকে তাদেরকে পুলিশ হয়রানি করছে। চাকরি না থাকায় তাদের পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তিনি বলেন, সরকার এবং মালিকের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল কোনো শ্রমিককে হয়রানি করা হবে না। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, যারা চাকরিচ্যুত হয়েছে তারা আবারো আন্দোলনে নামতে পারে।
গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশনের সভাপতি মোশরেফা মিশু গতকাল বলেন, শ্রমিকরা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন। তারা সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। অন্তত ৫০ জন শ্রমিক এখনো গ্রেফতার অবস্থায় আছেন। মিশু বলেন, সরকার ও মালিকপক্ষ যা বলেছিলেন তার কিছুই কার্যকর হয়নি। সরকার বলেছিল মামলা হবে না। কোনো শ্রমিককে হয়রানি করা হবে না। দায়েরকৃত মামলা তুলে নেয়া হবে। মালিকপক্ষ বলেছিলেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়া হবে। কোনো শ্রমিক ছাঁটাই হবে না। এসবের কিছুই হয়নি বলে মিশু উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের প্রতিশ্রুতি কার্যকর যাতে হয় সে জন্য শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রমিক নেতারা বসবেন।
জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, শ্রমিকরা অসহায় অবস্থায় আছেন। হাজার হাজার শ্রমিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, ৫ হাজারের ওপরে শ্রমিক এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের মধ্যে অনেক নারী শ্রমিকও রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেক রয়েছেন যারা একেবারেই নিরপরাধ। আন্দোলনেও তাদেরকে দেখা যায়নি। অথচ তারা মামলার আসামি হয়েছেন।
এদিকে শ্রমিকদের এই হয়রানি ও চাকরিচ্যুতির ব্যাপারে জানার জন্য বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।