একটা পরীর স্বপ্ন ছিল তার। কোলজুড়ে নামবে সেই পরী। ২০১৮ সালে যমজ দুই ছেলে জন্ম দেন রিফাত সুলতানা। নাম রাখেন রুদ্র আর ধ্রুব। বর্তমানে তাদের বয়স তিন বছর। গতবছর আবারও সন্তান সম্ভাবা হন রিফাত। এবার মনেপ্রাণে চাইছিলেন যেন একটা কন্যা সন্তান আসে তার কোলজুড়ে। এসেছেও। শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে গর্ভধারণের আট মাসেই এক শিশুকন্যার জন্ম দেন রিফাত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ছুঁয়েও দেখতে পারলেন না সদ্যজাত কন্যাকে। তার আগেই করোনার বিষে নীল হয়ে গেলেন ৩৩ বছর বয়সী বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরের অ্যাসোসিয়েট নিউজ প্রডিউসার রিফাত সুলতানা।
রিফাতকে ডাক্তার প্রসবের তারিখ দিয়েছিলেন আরও মাস দুয়েক পরে। তবে আট মাসের গর্ভাবস্থাতেই মার্চের ২৫ তারিখে তার পানি ভাঙতে শুরু হয়। ব্যস্ত হয়ে পড়ে অপ্রস্তুত পরিবার। পরে ২৬ মার্চ তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর আনোয়ারা খান মডেল কলেজ হাসপাতালে। গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিন আব্বাসির তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেওয়া হয়। টানা এক সপ্তাহ পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে বনশ্রীর নিজ বাড়িতে নেওয়া হয়। বাড়িতে ফেরার পর রিফাত জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকদের পরামর্শে গত ৭ এপ্রিল করোনা পরীক্ষা করার জন্য নমুনা দেওয়া হয়। পরীক্ষায় তার করোনা শনাক্ত হলে প্রথমে বাসাতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। পরে অবস্থা খারাপের দিকে গেলে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে চেষ্টা করেও শয্যার অভাবে তাকে ভর্তি করানো যায়নি।
সবশেষে গত বৃহস্পতিবার অনেক চেষ্টার পর রিফাতকে ভর্তি করে ইমপালস হাসপাতাল। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় ভর্তি করার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ঢোকানো হয় আইসিইউতে। এরমধ্যেই পরদিন শুক্রবার দুপুরে কন্যাশিশুর জন্ম দেন তিনি। সেই শিশুকে কোলে নিয়ে মুখে হাসি ফোটার আগেই ওইদিন বিকেলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরের অ্যাসোসিয়েট নিউজ প্রডিউসার রিফাত সুলতানা।
সিনেমার গল্পকেও যেন হার মানিয়েছে পরিবারটির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ। যে সন্তানকে মায়ের বুকের উমে থাকার কথা, সে এখন এভায়কেয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে। অন্য দুই সন্তান রুদ্র আর ধ্রুব পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে। তাদের চোখ মাকে খুঁজছে। মাকে খুঁজে না পেলেই জুড়ে দিচ্ছে গগণবিদারী কান্না। অথচ ওদের কান্না থামাবার মানুষটাকে কবরে মাটির নিচে শোওয়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এ কথা কে বোঝাবে ওদের। বাবা নাজমুলও ভর্তি হাসপাতালের শয্যায়। তিনিও শুয়েই নীরবে ফেলছেন চোখের জল। নিজে করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় বাচ্চা দুটিকে কোলে নিয়ে শান্ত করার সুযোগও মিলছে না তার। অদৃষ্টের এ কেমন পরিণতি, জন্মের পরই মা-হারা হতে হলো নিষ্পাপ তিন শিশুকে। দুই সন্তান রুদ্র আর ধ্রুব হয়তো বুঝতেও পারছে না সবার চোখে পানি কেন!
শুক্রবার রিফাতের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই বিষণ্ন দিন কাটছে পরিবার ও তার অফিসের সহকর্মীদের। এদের অনেকেই ফেসবুকে রিফাতের সঙ্গে কাটানো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে পোস্ট করছেন।
প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী বার্তা সম্পাদক তৃষ্ণা হোম রায় জানান, চলতি মাসেই ঘটা করে সাধের অনুষ্ঠান হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। সহকর্মীদের সবাই লাল শাড়ি-চুরি কিনেছিলেন। প্রথম যমজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগেও একাত্তর টিভিতে রিফাত সুলতানার সাধের অনুষ্ঠান হয়। আর এবার তো রাজকন্যা ঘর আলো করে আসবে। তাই আয়োজনে ভিন্নতাও রাখার ইচ্ছে ছিল রিফাতের। আমাদের প্রস্তুতিও শেষের দিকে ছিল। অথচ সবকিছু কেড়ে নিল করোনা।
২৫ মার্চ সবশেষ অফিসে ডিউটি করেছিলেন রিফাত। আরেক সহকর্মী নিউজরুম প্রডিউসার খাদিজা আক্তার শিমু বলেন, সদা হাস্যময়ী ছিলেন রিফাত। যমজ সন্তানের মা ছিলেন বলেই, সবার খোঁজ নিতেন। চঞ্চল স্বভাবের রিফাতের মেজাজে ছিল না রাগডাকও। অথচ অল্প বয়সেই করোনা আক্রান্ত হয়ে তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো।
রিফাতের স্বামী নাজমুল ইসলামও একাত্তর টিভির প্রডিউসার পদে কর্মরত। পরিবারে দুই সন্তান ছাড়া তার স্বামী নাজমুল, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর ও দেবরের বউও করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে নাজমুল ও তার মা উত্তরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সদ্য জন্ম নেওয়া কন্যাশিশুটিরও শারীরিক অবস্থা শঙ্কামুক্ত নয়। তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।