কাগজে-কলমেই দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা সরকারি প্রাইমারি প্রধান শিক্ষকদের

সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ। কিন্তু আজ অবধি তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না। আর্থিক সুবিধা দূরের কথা, দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি।

২০০৯ সালের যে মামলার কারণে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি বন্ধ ছিল, ২০১৪ সালে তার সুরাহা হলেও চালু হয়নি পদোন্নতি। কারণ ওই বছরই প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণী করায় প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ পদোন্নতির দায়িত্ব চলে যায় বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) অধীনে। কিন্তু পিএসসির এ বিষয়ে নীতিমালা না থাকা এবং বিষয়টি ত্বরিৎ সুরাহার উদ্যোগ না নেয়ায় ক্ষোভ হতাশায় নিমজ্জিত সারা দেশের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হাজার হাজার প্রধান শিক্ষক। প্রায় এক দশক পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি বন্ধ থাকায় ২০ হাজারেরও বেশি স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদ বছরের পর বছর শূন্য পড়ে থাকে। কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা ছাড়াই সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

সর্বশেষ গত বছর ২৩ মে ভারপ্রাপ্ত এসব প্রধান শিক্ষককে চলতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয়া হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু চিঠিতে বলা হয়। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও প্রধান শিক্ষক পদের কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধা তারা পাবেন না। সহকারী শিক্ষক হিসেবেই তারা যে বেতন ভাতা পান তাই বজায় থাকবে। শুধু তাই নয়, পরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রেও তারা কোনো ধরনের অগ্রাধিকার পাবেন না।

চিঠিতে আরো জানানো হয়, নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত এসব প্রধান শিক্ষক বদলিকৃত স্কুলে যোগদান না করলে তাদের চাকরিও থাকবে না। ফলে চাকরি রক্ষার্থে তারা নতুন স্কুলে যোগ দিতে বাধ্য হন।

কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা ছাড়া এবং বাধ্যতামূলক বদলিকরণের মাধ্যমে তাদের প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্ব প্রদান করায় শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। তার পরও চলতি দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয় যে, অন্তত এর মাধ্যমে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকা পদোন্নতির জট খুলবে।

কয়েকজন প্রধান শিক্ষকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা জেনেছি যখন থেকে চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তখন থেকে আমাদের মাসে এক হাজার ৫০০ টাকা করে বকেয়া বিল দেয়া হবে। তা ছাড়া আমাদেরকে নিয়মিত করারও কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা আবুল বাশার গত রাতে এ বিষয়ে বলেন, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান আমাদেরকে এ বিষয়ে জানিয়েছেন গত বছর।

সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা এক সময় ছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি। সামাজিকভাবে একজন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী হলেও চাকরির প্রটোকলে তিনি ছিলেন একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। বিষয়টি শিক্ষকদের কাছে ছিল খুবই বেদনার। যেকোনো সরকারি অফিসের তৃতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারীর চেয়ে অনেক বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ দাফতরিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয় একজন প্রধান শিক্ষককে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষকের পদটি তৃতীয় শ্রেণীর হওয়ায় দীর্ঘ দিন এ নিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত ছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক। দীর্ঘ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে তাদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও আবার দীর্ঘদিনের জন্য চাপা পড়ে যায় বিষয়টি। অবশেষে ২০১৪ সালে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদা দেয়া হয়। কিন্তু এখনো তারা শুধু নামেই দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ মর্যাদার অধিকারী।

বর্তমানে দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীরা বেতন পান দশম গ্রেডে। কিন্তু সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে। বিষয়টি শিক্ষকদের কাছে এতই বেদনার যে, সম্প্রতি বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কয়েক হাজার প্রার্থীকে থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ দ্বিতীয় শ্রেণীর কিছু পদের জন্য নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। তাদের মধ্যে যারা প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তারা ছাড়া অন্যরা দশম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। ফলে ক্ষোভ এবং হতাশা বিরাজ করছে শিক্ষকদের মধ্যে।

বর্তমানে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে ৬৫ ভাগ শূন্য পদ পূরণ করার নিয়ম সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির মাধ্যমে। বাকি ৩৫ ভাগ পদ পূরণ করা হয় সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে। পদোন্নতির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণের দীর্ঘ দিনের জটিলতার কারণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বছর ২৩ মে থেকে সহকারী শিক্ষক যারা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাদের চলতি দায়িত্ব দিয়ে চিঠি দেয়া শুরু করে। ২৩ মের আগ পর্যন্ত পুরনো ৩৭ হাজার ৬৭২টি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মধ্যে ২০ হাজারের কিছু বেশি স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য ছিল। এর মধ্যে ১৬ হাজারের বেশি পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণের কথা।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top