বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তথ্যমন্ত্রী থাকার রেকর্ড রয়েছে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মন্ত্রিসভায় স্থান পান তিনি। সেই থেকে একটানা সাত বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ে ছিলেন।
একই অবস্থা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের। তিনিও প্রায় সাত বছর মন্ত্রী ছিলেন। যদিও তিনি এক মন্ত্রণালয়ে ছিলেন না। এবারের মন্ত্রিসভা গঠনের আগে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, হাসানুল হক ইনু এবং রাশেদ খান মেনন অবধারিতভাবে মন্ত্রিসভায় থাকবেন।
কিন্তু মন্ত্রিসভা দেখে অনেকেই চমকে উঠেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্রদের কেউ এবারের মন্ত্রিসভায় নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে সেটি দেখে অনেকে বেশ অবাক হয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া এবং ১৪ দলীয় জোটের শরীকদের কারো জায়গা না হওয়া নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। ১৪ দলীয় জোটের শরীকদের মধ্যে রাশেদ খান মেননের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং হাসানুল হক ইনুর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল স্পষ্টতই মনঃকষ্টে ভুগছেন। মেনন বিবিসিকে বলেন, জোটের শরীকদের কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ায় তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, ১৪ দলের বৈঠক হলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।
তবে অন্যদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। নতুন মন্ত্রিসভা শপথের পর থেকে তিনি অনেকটা আড়ালে চলে গেছেন। গণমাধ্যমের সাথেও কোন কথা বলছেন না তিনি। এমনকি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বঙ্গভবনে দেখা যায়নি হাসানুল হক ইনুকে।
মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ায় তার হতাশা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন অনেকে।
১৪ দলের শরীকরা চাপ তৈরি করতে পারবে?
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন তাদের রাজনৈতিক শরীকদের মধ্য থেকে সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়াকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সে সময় ১৪ দলীয় জোটের অন্য শরীক দলগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সরকারের নানা সমালোচনা করতো।
যুদ্ধাপরাধের বিচার, নানা আর্থিক কেলেঙ্কারী এবং পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাবার কারণে ব্যাপক রাজনৈতিক চাপে পড়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে দেশ যখন অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল তখন ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ এবং জাতীয় পার্টি থেকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তখন জোটের শরীকদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এনিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেও এক ধরণের অসন্তোষ ছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা চেয়েছিলেন তাদের দলের ভেতর থেকেই মন্ত্রিসভায় বেশি স্থান দেয়া হোক এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো তাদের হাতেই থাকুক।
১৪ দলীয় জোটের শরীকদের মধ্যে মন্ত্রী হবার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে শুধু ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদের। অন্য দলগুলোর তেমন কোন কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাসদের মধ্যে ভাঙ্গনের কারণে দলটি আরো দুর্বল হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। হাসানুল হক ইনুর সাথে মতপার্থক্যের জের ধরে জাসদ (আম্বিয়া) গঠন করা হয়। সেখানে ছিলেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং মাঈন উদ্দিন খান বাদল।
হাসানুল হক ইনু যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন তার দলের একটি অংশ চেয়েছিল তিনি সরকার থেকে বেরিয়ে আসুক। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেবার জন্য আওয়ামী লীগের সাথে দরকষাকষির মতো অবস্থানে নেই ১৪ দলীয় জোটের অন্য শরীকরা।
আহমদ বলেন, ‘এখন আওয়ামী লীগ বিপুল বিক্রমে, একচেটিয়া মনোপলি তাদের। জোট সঙ্গীদের আগের যে চাহিদা বা আবেদন সেটা ওই অর্থে নেই। তাদের চাপ দেবার মতো কোন সক্ষমতা নেই।’
আহমেদ বলেন, পরবর্তীতে হয়তো মন্ত্রিসভায় দুই-একজন অন্তর্ভুক্ত হলেও হতে পারেন। তবে এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে সরকারের মধ্যে কোন চাপ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। ১৪ দলীয় জোটের শরীক দলগুলোর নেতারা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে এখন বেশ সাবধানী। জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার বলেন, একটি আদর্শকে কেন্দ্র করে ১৪ দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল।
শিরিন আক্তার বলেন, ‘আমরা জোটেই আছি। চিন্তা করবার কোন কারণ নেই’। মন্ত্রিসভা এবং সরকার পরিচালনা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেন জাসদ-এর আরেকটি অংশের (আম্বিয়া) নেতা মাঈন উদ্দিন খান বাদল। ‘আমি এটাকে খুব আশ্চর্যান্বিত হবার মতো বিষয় মনে করছি না।.. এটা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার’।
তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোতে মন্ত্রিসভায় অনেক সংযুক্ত হতেপারে। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ‘কেউ মন্ত্রী হলেন না, মন্তব্য করলেন। এটা তো আমি ঠিক মনে করবো না। যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন তো মন্তব্য করেন নাই।’
সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে জোটের শরীকদের অংশগ্রহণ কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? এর কোন রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে?
এমন প্রশ্নে খান বলে ‘১৪ দল নিজে বড় না। কিন্তু আরেকজনকে বড় করতে সহযোগিতা করে। সে হিসেবে ডেফিনিটলি ১৪ দল হ্যাজ কন্ট্রিবিউটেড অ্য লট (১৪ দল অনেক অবদান রেখেছে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও সেটি নিয়ে খুব বেশি সমালোচনামূখর হবে না ১৪ দলীয় জোটের শরীকরা। ভবিষ্যতে কোন সম্ভাবনা তৈরি হয় কি না সেদিকেই তারা তাকিয়ে থাকবে।