জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভের পতন শুরু হয়। যেমন-২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতি ছিল তিন হাজার ২৭২ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। সেখানে চলতি ২০১৮ সালের ১২ডিসেম্বরে এই রির্জাভের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৩৫ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে রির্জাভের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি কমে গেছে।
অথচ নির্বাচনী বছরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে। ঋণ প্রবৃদ্ধির হারও কমে যায়। কিন্তু তার পরও নির্বাচন এলে রিজার্ভের পরিমাণ কমতে থাকে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তাতে করে অনেকে বিদেশে টাকা পাচার করে দেন। আমদানি রফতানির আড়ালে বা হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা পাচার হয়। যে কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উত্থান পতন হয়েছে। নির্বাচনের বছরের শুরুর দিকে রিজার্ভ বেড়ে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চতা ছুঁয়েছে। এরপর নির্বাচনের কমপক্ষে ছয় মাস আগে থেকে রিজার্ভ কমতে শুরু করে। কোনো কোনো মাসে বাড়লেও পরিমাণে তা খুব কম। নির্বাচনী বা তার আগের মাসে রিজার্ভ কমে যায় বেশ। নির্বাচনের পর আবার বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরে নির্বাচনকে সামনে রেখেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ওঠানামা এখনো চলছে।
জানা গেছে, দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব টাকা অর্জিত হয় সেগুলো নির্বাচনী বছরে একটি চক্র বিদেশে পাচার করে দেয়। যে কারণে নির্বাচনী বছরে আমদানি ব্যয় অস্বাভিকভাবে বেড়ে যায়। রফতানি আয়ের মূল্য দেশে না আসার প্রবণতাও বাড়ে। একই কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বড় ধরনের ওঠানামা হয়। এ জন্য ডিসেম্বরের শুরুতে কার্ব মার্কেটের প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ছুঁয়ে যায়। এক বছরের আগেও যা ছিল ৮১-৮১ টাকা।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশ থেকে টাকা পাচারের আফঙ্কা বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করেছে। তার পরেও আমদানি ব্যয় কমেনি। বরং আরো বেড়েছে। শুধু সেপ্টেম্বরই আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৪ শতাংশের বেশি। গত অর্থবছরের একই মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল সাড়ে ১৭ শতাংশের বেশি। আমদানি ব্যয়সহ অন্যান্য খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বাড়ার কারণে রিজার্ভে গিয়ে চাপ পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩০ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার। ২৯ আগস্ট তা কমে তিন হাজার ২৮০ কোটিতে দাঁড়ায়। ১৮ অক্টোবর তা আরো কমে তিন হাজার ২১২ কোটি ডলার। ৩১ অক্টোবর আরো কমে তিন হাজার ২০৮ কোটিতে নেমে যায়। ২০ নভেম্বর তা আরো কমে তিন হাজার ১০৫ কোটি ডলারে নেমে যায়
প্রাপ্ত্য তথ্যে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে পরে রিজার্ভ বেশ ওঠানামা ছিল। ওই নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের আগস্টে রিজার্ভ বেড়ে এক হাজার ৬২৫ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে আবার কমে এক হাজার ৬১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে আবার বেড়ে এক হাজার ৭৩৪ কোটি ডলারে ওঠে। নভেম্বরে আবার এক হাজার ৭১০ কোটি ডলারে নেমে যায়। ডিসেম্বরে বেড়ে এক হাজার ৮০৯ কোটি ডলারে দাড়ায়। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এটি আবার বাড়তে থাকে। ওই মাস শেষে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৮১২ কোটি ডলারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের জুনে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার। জুলাইয়ে তা কমে ৫৮২ কোটি ডলার, আগস্টে সামান্য বেড়ে ৫৯৬ কোটি ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা আবার কমে ৫৮৬ কোটি ডলার নেমে যায়। অক্টোবরে তা আরো কমে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি ডলারে। নভেম্বরে আরো কমে ৫২৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে ওই মাসে রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ৫৭৯ কোটি ডলারে ওঠে। জানুয়ারিতে আবার কমে ৫৫৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ফেব্রুয়ারিতে আবার বেড়ে ৫৯৫ কোটি ডলার ওঠে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে পরেও রিজার্ভে উত্থান পতন হয়। ২০০১ সালের জুলাইয়ে রিজার্ভ ছিল ১১৪ কোটি ডলার। আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৫ কোটি ডলারে। সেপ্টেম্বরে আবার কমে ১১৫ কোটি ডলারে নেমে যায়। অক্টোবরে আরো কমে ১০৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। নভেম্বর থেকে রিজার্ভ আবার বাড়তে থাকে। নভেম্বরে এর পরিমাণ বেড়ে ১১১ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে তা আরো বেড়ে ১৩০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।