সোলাইমান হোসেনের প্রকৃত বয়স ৩৭ বছর পেরিয়ে গেছে। জালিয়াতি করে বয়স ১০ বছর কম দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়েতে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) প্রকৃত বয়সই রয়ে গেছে। বর্তমানে এনআইডির সঙ্গে চাকরির বয়সের মিল না থাকায় তার বেতন আটকে গেছে।
আব্দুর রউফ চাকরি করেন ফায়ার সার্ভিসে। তিনিও প্রকৃত বয়সের চেয়ে ৮ বছর কম দেখিয়ে চাকরি নিয়েছেন। এনআইডিতে তার বয়স ৩৫ হলেও সার্ভিস বুকে ২৭ বছর। বয়সের পার্থক্য থাকায় তারও বেতন হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে উল্লেখিত নাম ও ঘটনা কাল্পনিক হলেও এমন শতশত জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আর জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে চাকরিরত ওই ব্যক্তিরা এখন নির্বাচন কমিশনে ঘুরছেন এনআইডিতে লেখা বয়সও কমিয়ে নেওয়ার জন্য।
এদিকে ঘটনার সংখ্যা অত্যাধিক হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একদিকে মানবিক বিষয়, অন্যদিকে দুর্নীতির আশ্রয়। তাই কঠোর হয়েও হতে পারছে না সংস্থাটি।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, বয়স জালিয়াতি করে সবচেয়ে বেশি চাকরি নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ রেলওয়েতে। কেননা সেখানে কর্মরতরাই এনআইডি সংশোধনের আবেদন বেশি করছেন। এরপরেই রয়েছে জেলা প্রশাসন। এক্ষেত্রে খুলনা, ময়মনসিংহ এবং জামালপুরের সরকারি চাকুরিজীবিদের মধ্যে বয়স জটিলতায় পড়াদের আবেদন বেশি পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস থেকেও অসংখ্য আবেদন এসেছে।
ইসি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বয়স জটিলতা সংক্রান্ত আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশন পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে দিয়েছে। ইসির যুগ্ম সচিব ও এনআইডি শাখার পরিচালক (অপারেশন্স) মো. আবদুল বাতেনকে প্রধান করে গঠিত কমিটি আবেদনগুলো যাচাই করে সংশোধনের যৌক্তিকতা যাচাই করছেন।
নির্বাচন কমিশন সকল আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের একটি নির্দেশনাও পাঠিয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে, ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার পর এনআইডির বিভিন্ন তথ্য সংশোধন সংক্রান্ত জটিল আবেদনগুলো ওই বিশেষ কমিটি নিষ্পত্তি করবে।
এছাড়া প্রাপ্ত আবেদনগুলোর মধ্যে যে সকল আবেদনের সঙ্গে যথাযথ কাগজপত্র রয়েছে, বিশেষ করে শিক্ষাগত যোগ্যতার বোর্ডের সনদ, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ের এনআইডির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে, কেবল সে সকল আবেদনগুলো মাঠ পর্যায়ে বা অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিষ্পত্তি করবেন।
অন্যদিকে যে আবেদনকারী উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষাবোর্ড এবং মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে থেকে প্রাপ্ত সনদ দাখিল করে চাকরি পেয়ে অস্বাভাবিকভাবে বয়স বা অন্যান্য তথ্যাদি সংশোধনের আবেদন করেছেন, সে সকল আবেদন এনআইডি শাখার গঠিত বিশেষ কমিটি বা সংশোধন কমিটির নিকট পাঠাতে হবে।
কেবল রেলওয়ে, ফায়ার সার্ভিস বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ই নয়, অন্য যে সকল আবেদন আইন ও বিধির আলোকে নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না, সে সকল আবেদনও পরীক্ষা করে নিষ্পত্তির জন্য ওই কমিটির কাছে পাঠাতে হবে।
এ বিষয়ে সংশোধন কমিটির প্রধান মো. আবদুল বাতেন বলেন, এ পর্যন্ত শতাধিক ‘বয়স জটিলতা’ সংক্রান্ত আবেদন যাচাই করে ‘ইতিবাচক’ এবং ‘নেতিবাচক’ মতামত দিয়ে কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা সবচেয়ে বেশি আবেদন পেয়েছি রেলওয়ে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং ফায়ার সার্ভিসে কর্মরতদের মধ্য থেকে।
তিনি বলেন, এখানে একটা মানবিক বিষয় আছে। এরা সকলেই তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। কেউ পাঁচ বছর, কেউ দশ বছর চাকরি করে এখন বেতন তুলতে পারছেন না। তারা অনিয়ম করে চাকরি নিয়েছে কি-না, সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। কিন্তু আমরা বয়সের অনেক পার্থক্য পাচ্ছি। কারো কারো বয়স মায়ের চেয়ে বেশি। কারো বয়স আবার সন্তানের সমান। তারা হয়তো চাকরি নিয়েছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বোর্ডের সনদ দাখিল করে। এ ধরনের আবেদনগুলো তো আমরা সংশোধন করে দিতে পারি না।
যাদের এনআইডির সঙ্গে সার্ভিস বুকে উল্লেখিত বয়সের মধ্যে দু’এক বছরের পার্থক্য হচ্ছে ও তেমন কোনো জটিলতা নেই এবং পিতা-মাতা, ভাই-বোন বা সন্তানের বয়সের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাদেরটা আমরা ঠিক করে দিচ্ছি। অন্যদেরটা দিচ্ছি না। এক্ষেত্রে একটা সুপারিশ করা হচ্ছে মানবিক দিক বিবেচনা করে যে, তারা তো একটা প্রতিষ্ঠানে ১০ বছর বা ৫ বছর সার্ভিস দিয়েছেন। এক্ষেত্রে যদি এমন কোনো সুপারিশ তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে আনতে পারেন, যেখানে বলা থাকবে, যে বাড়তি বয়স বাদ দিয়ে যতদিন থাকবে ততদিন চাকরি করবেন, তাহলে সংশোধন করা যাবে। অর্থাৎ কেউ যদি ১০ বছর বয়স গোপন করে চাকরি নিয়ে থাকেন, তবে তিনি ১৯ বছর চাকরি করবেন, এমন লিখিত যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দেয়, তবে এটা ঠিক করা যায়।