“কে ওই শুনাল মোরে আযানের ধ্বনি-
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর”
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী,
কি মধুর আযানের ধ্বনি”-
বিখ্যাত ‘আযান’ কবিতার লাইনগুলো শুনলে মনে পড়ে যায় মহাকালের মহাকবি কায়কাবাদের নাম! কবি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার অসামান্য সাহিত্যভাণ্ডারের জন্য কবি বেচে আছেন আমাদের মাঝে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কবি কায়কোবাদ খ্যাতিমান কবি হিসেবে দেশে বিদেশে সমানভাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। মহাকবি কায়কোবাদ ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা পূবপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালের ২১ জুলাই কবি মৃত্যুবরণ করেন। মহাকবি কায়কোবাদের ৬৮তম মৃত্যুবাষির্কী আজ। পোস্টমাস্টারের চাকরি করে তিনি কবিতা লিখে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। কবি কায়কোবাদ দীর্ঘজীবন লাভ করেন।
কায়কোবাদ কবির সাহিত্যিক নাম হলেও তার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ কাযেম আল কোরেশী।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৮৭০ সালে কায়কোবাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিরহ বিলাপ’ প্রকাশ হলে বাংলা সাহিত্যঙ্গণে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কায়কোবাদ মূলত একজন গীতিকবি। এছাড়া সনেট, মহাকাব্য, কাহিনীকাব্য ও গানেও ছিলেন সমানভাবে পারদর্শী। তাই তৎকালীন সময়ে কবিমহলে ব্যাপক প্রসংশিত হয়েছেন কায়কোবাদ। মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনিই প্রথম মহাকবি উপাধি লাভ করেন। বাংলা সাহিত্যে কায়কোবাদের অসাধারণ অবদানের জন্য সারাদেশের মানুষের কাছে কবি সমাদৃত হলেও তার জন্মন্থান ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার অবহেলিত কবি।
আগলা গ্রামে কবির তেমন কোন স্মৃতি চিহ্ন আর অবশিষ্ট নেই। আর যে স্মৃতিগুলো আছে সেগুলোও নিচিহ্ন হতে বসেছে।
কবির মৃত্যুর পর তার পৈতৃক বাড়ির একটি অংশ বিক্রি করলেও বাদবাকি অংশ বেদখল হয়ে যায়।
কায়কোবাদের ভক্ত অনুরাগীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগলা গ্রামে এসে কোন স্মৃতিচিহ্ন না দেখে বিষ্মিত হন।
বাড়িতে কবির বংশধরেরা না থাকলেও রয়েছে কবির আমলের বেশ কয়েকটি বড় বড় আম গাছ। গাছগুলো দেখলে কবির কথাই মনে পড়ে। ২০০৬ সালে কবির বাড়ির সামনের রাস্তাটি কবির নামে নামকরণ করে একটি ফলক নির্মাণ করা হয়। ফলকটিও কে বা কারা ভেঙে ফেলেছে। ফলে রাস্তাটি যে কায়কোবাদের নামে করা তাও মুছে যাচ্ছে।
১৯৭২ সালে সুবিদ আলী নামের জনৈক ব্যক্তি কবির সম্মনার্থে আগলা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন কায়কোবাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের প্রায় ৪ শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। কিন্তু বিদ্যালয়ের পাঠাগারে কায়কোবাদের কোন বই নেই। যার জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কবির সর্ম্পকে জানতে পারছে না।
মাছপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালযের সহকারী শিক্ষক অধন্য রাজবংশী জানান, আমরা মহাকবি গ্রামের জন্মগ্রহণ করেছি বলে নিজেকে গর্ববোধ মনে করি। কিন্তু কবি সর্ম্পকে আমরা তেমন কিছুই জানতে পারছি না। আর সেটা আমাদের লজ্জাজনক ব্যাপার! কবির স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে হলে নবাবগঞ্জে একটি গণগ্রন্থাগার চালু করা দরকার।
কবির বাড়ির পশ্চিমে ১৯৮৩ সালে আগলা মাছপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত করা হয় কায়কোবাদ যুব ক্লাব ও গণপাঠাগার। জায়গাটি বরাদ্দ দেন স্থানীয় জনৈক বাবু হরিষচন্দ্র পোদ্দার। গত ১০ বছর ধরে পাঠাগারটির সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এলাকার মাদকসেবীদের আড্ডাস্থানে পরিনত হয়েছে। নবাবগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলার চৌরাস্তায় কায়কোবাদের নামে গোল চত্বর নির্মাণ করা হলেও সেটি ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীনতা চত্বর। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে চত্বরটি পুনস্থাপনের দাবি জানিয়ে আসলেও দীর্ঘ ১০ বছরেও তা বসানোর কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
কবি রাজু ইসলাম কায়কোবাদ সর্ম্পকে বলেন, বাংলা সাহিত্যে অনন্য অবদান রেখেছেন এ কবি। তৎকালীন সমাজে তো বটেই এখন পর্যন্ত তার অসাম্প্রদায়িক চেতনা সর্বজনবিদিত। মহাশ্মশান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। দেশপ্রেমের জন্য তার তুলনা মেলা ভার। মহাশ্মশান এর পূর্ণ মূল্যায়ণ করেই এর সারাংশ থেকে মুনীর চৌধুরীর লেখা নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’। ধর্মীয় চেতনায় তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তার আজান কবিতাটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ আমি মনে করি তাকে যথাযথ মূল্যায়নের সময় এখনই।
কায়কোবাদরে নাতি টুটুল আলম কোরেশী বলেন, কবির বাড়িটি দখলমুক্ত করে করির নামে একটি পাঠাগার ও গবেষণাগার নির্মাণ হলে কবির সর্ম্পকে অজানা তথ্য জানা যাবে।
কায়কোবাদ স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আরশাদ আলী বলেন, কায়কোবাদ নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা গ্রামের জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই শতধন্য এই গ্রাম। কবির মৃত্যুর পর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আসেনি কেউ?
তারপরও কবি আমাদের জন্য বাংলা সাহিত্যের যে রত্নভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে রেখে গেছেন তার জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মহাকালের মহাকবি কায়কোবাদ।