ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের নদ-নদীতে পানি বাড়তে থাকায় বন্যার বিস্তৃতিও বাড়ছে। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, সারাদেশের নদ-নদীগুলোর ১০১টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের ৮৬টি পয়েন্টে পানি বেড়েছে। এরমধ্যে ১৪টি স্টেশনের পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তারমধ্যে ময়মনসিংহ বিভাগের কয়েকটি নদীতে পানির বিস্তৃতি বাড়ছে বলেও উল্লেখ করা হয়। কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া জানান, বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিলেট, নেত্রকোণ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সেই সাথে ব্রহ্মপুত্র নদের পানির প্রবলতা বাড়বে। চলতি মাস ও আগামী জুলাই মাসে ময়মনসিংহ বিভাগে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এদিকে হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, দুর্গাপুরসহ শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী নদীগুলোতে পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় ময়মনসিংহ বিভাগে ভয়াবহ বন্যার সম্ভবনা রয়েছে।
শুধু তাই নয়, দেশের আবহাওয়া পরিস্থিতির পূর্বাভাস তুলে ধরে বর্ষা-বন্যার এ মৌসুমে কৃষকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সেখানে ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা ও শেরপুরে ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। সেইসাথে এসব জেলায় বিরাজমান বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কৃষি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গত মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৭ দশমিক ১ শতাংশ বেশি বর্ষণ হওয়ায় ওই মাসে দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে। যার রেকর্ড ছিলো ৫৬৯ মিলিমিটার।
জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বন্যার প্রাথমিক সময়কাল ধরা হলেও অনেক সময় আবার আগাম বন্যাও হয়। তবে সবচেয়ে বড় বন্যাগুলো অতীতে হয়েছে বর্ষা মৌসুমেই। ময়মনসিংহের ভূমি চিরে বয়ে চলা ঝিনাই, আয়মন, সুতিয়া, বানার, খিরু, ঠাডাকুড়া, ঘরোটা, সিমাহালি, নরসুন্দা, বোখাই, নিতারী, সোমেশ্বরী, কংশ, গুনাই, কাঁচামাটিয়া, পানকুরা, সাইদুল, মগরা, রাংরা, খারমোরী, মহাদেব, যদুকাটা, ধনু, বোয়ালাই, শিরখালি, সিংড়া, চেল্লাখালি, মতিচিক, চালহি, বংশাই, মানস, পুতিয়া, জিনজিরাম, সুবনফিরি, বলেশ্বর, ভোগাই কংসা, কউলাই, সিলাই, খারমেনি, সাতারখালি, তারাটিয়া, ঘাগটিয়া, ঝগড়াখালি, নবগঙ্গা, মরা নেতাই, বেনিপোড়া, রূপালী, রাঙ্গানিয়া, মেকিয়ারকান্দা, মালিঝি, খড়িয়া, বালুয়া, আনই, আখিল, বাইজানাসহ প্রায় অর্ধশত নদ-নদীতেই পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে ময়মনসিংহের বিভিন্ন নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীর স্রোতের কারণে ভাঙ্গনের পথে রয়েছে। এ অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে। নদীর পানি যেহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোর। বেশ কয়েকটি এলাকায় রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে ফসলী জমি, মাছের খামার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার অবকাঠামো।
এদিকে টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোণার কলমাকান্দা ও বারহাট্টা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ১২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে অন্তত ১৭০০ বাড়ি-ঘরে পানি ঢুকেছে। সোমবার জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো আক্তারুজ্জামান জানান, ভারি বৃষ্টির পাহাড়ি ঢলের কারণে সোমেশ্বরী নদীর কলমাকান্দায় তিন নম্বর পয়েন্টে বিপদ-সীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি বইছে।
চলতি মাসেই হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মেনংছড়া নদীর পাড় ভেঙ্গে তিন শতাধিক বাড়ী নদীর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। হালুয়াঘাটের ভূবনকুড়া-কুমারগাতি গ্রামের মাঝামাঝি অবস্থানে নদীর ভাঙ্গনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ফসলি জমি, ফিসারি ও অন্যান্য স্থাপনা। পাহাড়ী ঢলে ইতিমধ্যে চারটি গ্রাম অর্থাৎ কুমারগাতি, পলাশতলা, ভূবনকুড়া ও মাজরাকুড়ার একাংশ মিলিয়ে তিন শতাধিক মানুষের বাড়ীতে পানি ঢুকেছে। এদিকে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা ইউনিয়নের মরিচারচর নামাপাড়া ও উত্তরপাড়া এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদের ভাঙন তীব্র আকার ধারন করেছে। এর ফলে বাড়িঘর, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাঁশঝাড় ও ফসলি জমী নদীতে বিলীন হচ্ছে। ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মানববন্ধন করেছে এলাকার কয়েকশ নারী-পুরুষ।
যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বর্ষণে জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতির আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। জেলার সাতটি উপজেলায় ৪৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে পরে দুই উপজেলায় দুই শিশু মারা গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি ৬ সেন্টিমিটার বেড়ে মঙ্গল বার সকালে যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করা জেলার সাত উপজেলার ৪৬টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুকুরের মাছ ,গরুর খাবার, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশের বেশি সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা। আশ্রয়ের জন্য বানভাসা মানুষগুলো পরিবারের স্বজনদের নিয়ে উঁচু সড়ক ও ব্রিজে অবস্থান নিয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে প্রায় একশত পঞ্চাশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে।
জামালপুরে বন্যা কবলিত এলাকায় প্লাবনের দুর্গতিতে পরেছে ৬৬ হাজার পরিবারের প্রায় ২লাখ ৫০হাজার মানুষ। এদিকে পানি বাড়ার সাথে সাথে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।বন্যা আক্রান্ত অসহায় মানুষেরা বলছে তাদের কাছে এখন ত্রাণ পৌঁছেনি।
শেরপুরের নকলায় বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা মৃগী নদীর দক্ষিণ তীরে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এতে একদিকে শত শত পরিবারের ফসলি জমি ও ভিটেবাড়ি বিলীন হচ্ছে নদীগর্ভে, হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে আরও অনেক মানুষর জীবনমান। জানা যায়, নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা ইউনিয়ন ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা মৃগী নদীর কিছুটা এলাকাজুড়ে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর সাথে সাথে শুরু হয় ভাঙ্গন। এরই মধ্যে গত কয়েক বছরে কয়েকশ একর আবাদী জমি, শতাধিক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, গাছপালা, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, কবরস্থানসহ অনেকের স্বপ্ন ওই নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে চরঅষ্টধর ইউনিয়নের দ্বিতীয়বারের মতো স্থানান্তরিত হওয়া নারায়ণখোলা দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক ঘরবাড়ি, কৃষি আবাদী জমি, রাস্তাঘাটসহ অনেক কিছু। এছাড়া চন্দ্রকোনা ইউনিয়নের বেতমারি, চরবাছুরআলগা ও পার্শ্ববর্তী জামালপুর সদরের হালগড়াচরসহ বেশ কয়েকটি এলাকার জনগণের যাতায়াতের একমাত্র সড়কের বেশ কিছু অংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া উপজেলার একমাত্র শতবর্ষী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চন্দ্রকোনা রাজলক্ষ্মী উচ্চ বিদ্যালয় ও চন্দ্রকোনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা ও ফসলি জমিসহ রাস্তাঘাট রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ফলে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ওইসব এলাকার হাজারও মানুষের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গেজরিডার (পানি পরিমাপক) মো. মোস্তফা জানান, শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন ১০-১৫ সেন্টিমিটার করে বেড়ে চলেছে।
এব্যাপারে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: শামসুদ্দোহা ময়মনসিংহ লাইভকে জানান, আমরা নদী ভাঙ্গনের খবর পাচ্ছি ও দ্রুত সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে গত তিনদিন ধরে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদে প্রতিদিন এক ফুট করে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো: মিজানুর রহমান ময়মনসিংহ লাইভকে বলেন, ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় ইতোমধ্যে একটা বন্যা হয়ে গেছে। আমরা সেখানে পর্যাপ্ত কাজ করেছি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় সেখানকার লোকজনের মধ্যে ত্রানবিতরণসহ তাদেরকে সার্বিক সহযোগীতা করা হয়েছে। আর বন্যার আগাম প্রস্তুতি হিসেবে প্রতি উপজেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনও আগামী বৃহস্পতিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে বন্যার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিবে।