কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পরামর্শ দিয়ে আসছেন, যেমন- পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চা করা ও প্রতিরাতে পর্যাপ্ত ঘুমানো।
আমাদের শরীর রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রকৃতিগতভাবে যে ক্ষমতা পেয়েছে সেটাই হচ্ছে রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র বা ইমিউন সিস্টেম। কিন্তু আমাদের জীবনযাপনে কিছু ভুলের কারণে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে যেতে পারে। দুর্বল ইমিউন সিস্টেম কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রমণ থেকে নিরাময় দিতে ব্যর্থ হতে পারে। তাই এই মহামারিতে টিকে থাকার প্রয়াসে কোন বিষয়গুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খর্ব করছে তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এখানে ইমিউন সিস্টেমের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে এমন ১৩টি বিষয় উল্লেখ করা হলো।
কম ঘুম: পর্যাপ্ত ঘুম না গেলে ভাইরাস বা জীবাণুরা সহজেই আক্রমণ করতে পারে। সংক্রমণ থেকে নিরাময় পেতেও দেরি হয়। এর কারণ হচ্ছে, ঘুম-বঞ্চিত শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইকারী কোষ ও অসুস্থতা থেকে নিরাময় প্রদানকারী প্রোটিন (অ্যান্টিবডি) উৎপাদন করতে পারে না। ঘুমের সময় শরীরে ইমিউন সিস্টেমকে সহায়তাকারী কিছু প্রোটিন নিঃসরিত হয়, যাকে সাইটোকিন বলে।
দুশ্চিন্তা করা: মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষমতা কমে যায়। প্রতিনিয়ত উদ্বিগ্ন থাকলে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রতিনিয়ত মানসিক চাপে ফ্লু, করোনাভাইরাস, হার্পিস, শিনগ্লেস ও অন্যান্য ভাইরাস প্রতিহত করা কঠিন হয়। অবান্তর দুশ্চিন্তা দূর করতে না পারলে অথবা উদ্বেগে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হলে থেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বলুন।
ফল ও শাকসবজি কম খাওয়া: পর্যাপ্ত ফল ও শাকসবজি না খেলে শরীর বেশি করে সংক্রমণ বিতাড়ক শ্বেত রক্তকণিকা উৎপাদন করতে পারে না। সতেজ কৃষিজাত খাবার, বাদাম ও বীজে প্রচুর পরিমাণে জিংক, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই ও শরীরের জন্য দরকারি অন্যান্য পুষ্টি পাওয়া যায়। উদ্ভিজ্জ খাবারে প্রচুর ফাইবারও থাকে, যা শরীরের চর্বি কমাতে সহায়তা করে। এর ফলেও ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়।
গাঁজা সেবন: গাঁজার ধোয়া ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এটি নিয়মিত সেবন করলে নিকোটিন সিগারেটের মতোই একইরকম শ্বাসতন্ত্রীয় সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘসময় গাঁজা সেবনে কাশির সঙ্গে রঙিন শ্লেষ্মা বের হতে পারে ও ফুসফুসে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বেশি চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া: তেল জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইকারী শ্বেত রক্তকণিকার কার্যক্রমে বাধা দিতে পারে। উচ্চ চর্বির খাবার সময় পরিক্রমায় অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বিনষ্ট করে, কিন্তু যথাযথ ইমিউন রেসপন্সের জন্য এই ভারসাম্যেরও গুরুত্ব রয়েছে। ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে চাইলে চর্বি ও চিনির পরিমাণ কম রয়েছে এমন খাবার ডায়েটে রাখুন, যেমন- সামুদ্রিক খাবারের মতো চর্বিহীন প্রোটিন, টার্কি ও অন্য মুরগির মাংস এবং গরুর চর্বিহীন মাংস। স্থূল লোকদের ফ্লু, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
বাইরে বের না হওয়া: সূর্যালোক ইমিউন সিস্টেমের বিশেষ কোষ টি-সেলকে শক্তিপূর্ণ করতে পারে, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে। কিন্তু বাইরে বের হওয়ার অন্যান্য উপকারিতাও রয়েছে। অনেক গাছ ফাইটনসাইড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাবস্ট্যান্স তৈরি করে। একারণে সবুজ পরিবেশে শ্বাস নিলে ইমিউন সিস্টেমের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ধূমপান: সিগারেট ও অন্যান্য উৎসের নিকোটিন ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের যুদ্ধ করার ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। ভেপিংয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শুধু নিকোটিন নয়, ই-লিকুইডের অন্যান্য কেমিক্যালও ইমিউন রেসপন্সকে দমিয়ে রাখতে পারে।
মদ্যপান: অ্যালকোহলের ওভারডোজ নিলে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত শরীরের ইমিউন সিস্টেম ধীর থাকে। অত্যধিক অ্যালকোহল পানে সময়ের আবর্তনে শরীরের নিজেকে সারিয়ে তোলার ক্ষমতা ভোঁতা হয়ে যায়। একারণে লিভার রোগ, নিউমোনিয়া, যক্ষা ও কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
মন খারাপ করে থাকা: প্রমাণ রয়েছে যে দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়। মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হলে ইমিউন সিস্টেমের ওপর যে প্রভাব পড়ে তা ছয়মাস পর্যন্ত থাকতে পারে, কিন্তু গভীর দুঃখে এর স্থায়িত্ব আরো বাড়তে পারে। দুঃখকে জিইয়ে রাখলে ইমিউন সিস্টেমের পক্ষে সংক্রমণ প্রতিহত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই দীর্ঘসময়েও প্রিয়জনের মৃত্যু বা অন্যান্য শোক কাটিয়ে ওঠতে না পারলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করুন।
ব্যায়াম না করা: নিয়মিত দ্রুত হাঁটা বা দৌঁড়ের মতো অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করলে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সক্ষমতা বাড়ে। এর কারণ হচ্ছে, এসব ব্যায়ামে শরীরের সর্বত্র অধিক কার্যকরভাবে রক্ত পৌঁছতে পারে, এর ফলে রক্তের সঙ্গে জীবাণু বিরোধী সাবস্ট্যান্সও যেতে পারে।
সহবাস না করা: গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতিসপ্তাহে যৌনমিলন করেছেন তাদের ইমিউন সিস্টেম এর বিপরীত গ্রুপের লোকদের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। যৌনমিলনে জীবাণু-বিরোধী সাবস্ট্যান্স ইমিউনোগ্লোবিউলিন এ এর মাত্রা বাড়ে। কিন্তু অধিক সহবাসের ফল ভালো নাও হতে পারে। গবেষণায় আরো পাওয়া গেছে, যেসব দম্পতি সপ্তাহে দু’বারের বেশি যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন তাদের শরীরে ইমিউনোগ্লোবিউলিন এ এর মাত্রা সেসব দম্পতির তুলনায় কম ছিল যারা সপ্তাহে একবারও সহবাস করেননি।
কিছু ওষুধ সেবন: অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট, অ্যালার্জি, আর্থ্রাইটিস, লুপাস ও আইবিএসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ইমিউন সিস্টেমের কার্যক্ষমতা কমাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, করটিকোস্টেরয়েড বা টিএনএফ ইনহিবিটর ও কেমোথেরাপি ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়। একারণে চলতি মহামারিতে প্রেসক্রিপশনের ওষুধ অ্যাডজাস্ট করতে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।