কবিরাও নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন। ভোট চাইতে ঘুরেছিলেন দ্বারে দ্বারে। অনেকেরই হয়ত জানা নেই সে কথা। এমনই এক নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ভোটের জন্য অনেকটা নমনীয় হতে হয়েছিল মাথা না নোয়ানো এই চিরবিদ্রোহীর। আর সেই নির্বাচনে দল থেকে কবি নজরুলকে দেওয়া হয়েছিল তিন’শ টাকা, যা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল নগন্য। ভোট চাইতে যে এতো খরচ লাগে সে বিষয়ে তেমন জ্ঞান ছিলনা নজরুলের। উপায় না পেয়ে কবি নিজের পকেট থেকেই টাকা খরচ করে ভোট পাওয়ার আশায় স্থানীয় বহু নেতার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি তাতে। পাশে পান নি ওইসব নেতাদের কাউকেই। তার প্রচারণায় তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি তখন। ভোটে জিততে ফরিদপুরের প্রভাবশালী পীর বাদশা মিয়ার কাছ থেকে নজরুলের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বানসংবলিত এক ‘ফতোয়া’ও দেয়া হয়েছিল।
মূল ঘটনায় আসা যাক, ১৯২৫ সালে কবি নজরুল শ্রমিক স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন, রাজনৈতিক কাজে তৎকাল তিনি বাংলার নানা প্রান্তে গমন করেন, ঘুমন্ত বাংলার মানুষ কে জাগিয়ে বস্তুত্ব তাদের চেতনায় কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিলেন কবি ।
সেই বছর ভারতীয় ব্যবস্হাপক সভার প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন নজরুল, ১৯২৬ সালে স্বরাজ পার্টির হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে ঢাকা বিভাগের (ঢাকা,ফরিদপুর ময়মনসিংহ, বরিশাল জেলা নিয়ে গঠিত) মুসলিম প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পত্র জমা দেন, স্বরাজ পার্টির প্রার্থী মনে করে নির্বাচনে আর্থিক সহযোগিতা পাবেন এবং ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় জয়লাভ করতে পারেন বলে কবি যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন যদিও কবির বিশিষ্ট কবি বন্ধু মুজাফফর আহমদ(বাম রাজনীতিক) কবিকে নির্বাচনে লড়তে নিষেধ করেন ।
সে সময় প্রত্যেক ভোটারের দুটি করে ভোট দেয়ার ক্ষমতা ছিল, ঢাকা বিভাগ থেকে দুজন মুসলিম প্রার্থী নির্বাচিত হবেন, তৎকালীন সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটার হওয়ার নিয়ম ছিল, উক্ত আসনে মোট ভোটার ছিল ১৮১১৬ জন, নির্বাচনে মোট পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, ঈসমাইল হোসেন চৌধুরী (বরিশালের জমিদার) আব্দুল হালিম গজনভী(টাঙ্গাইলের জমিদার) ঢাকা নবাববাড়ির খাজ আব্দুল করিম, কাজি নজরুল ইসলাম ও মফিজুদ্দিন আহমেদ।
স্বরাজ পার্টির ও বিধান চন্দ্র রায়ের পক্ষ থেকে দেয়া ৩০০ টাকা নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন কবি নজরুল, নির্বাচন উপলক্ষে কবি বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনে প্রচারণায় যোগ দেন তখন একশ্রেণির লোক কবিকে কাফের, হিন্দু বলে বিশেদাগার শুরু করে, কবি তখন ইসলামের ধর্ম ও ঐতিহ্য কে ভিত্তি করে বেশ কিছু কবিতা, গান, গজল রচনা করেন।
উপায় না পেয়ে কবি তৎকালীন ফরিদপুরের বিখ্যাত পীর বাদশাহ মিঞার নিকট থেকে বাণী আদায় করেন, পীর বাদশাহ মিঞার বাণীতে বলা হয়েছিল , বাংলার শ্রেষ্ঠ বীর, আলেম সমাজের পয়গাম, ঢাকা বিভাগের ব্যবস্থাপক পরিষদের মুসলমান ভোটারদের প্রতি, নজরুল ইসলাম নির্ভীক সত্যদর্শী জনপ্রিয় যুবক, তিনি দেশ ও জাতির জন্য স্বর্বস্ব ত্যাগ করিয়াছেন এবং দীর্ঘদিনের জন্য কারাভোগ পর্যন্ত করিয়াছেন, তাহার অনেক গুলি পুস্তক গভর্নমেন্ট কতৃক বাজেয়াপ্ত হইয়াছে, সাহিত্য জগতে তিনি বাংলার মুসলমানদের গৌরব রক্ষা করিয়াছেন, একমাত্র তাহার লেখা দেখাইয়া দিয়েছে যে বাংলার মুসলমান সাহিত্য চর্চা করিয়া বিশ্ব সাহিত্য দরবারে আসন পাইতে পারে,আশাকরি মুসলমান গণ জনগণকে দেখাইয়া দিবেন যে বাংলার মুসলমান ও তাহাদের কবি’র এবং বিদ্যা ও গুণের কদর করিতে পারে।
আর যদি….. তবে জগতের লোক হাসিবে ও ধিক্কার দিয়ে বলিবে যে বাংলার মুসলমান বিদ্যা ও গুণের কদর করিতে জানেনা। অতএব আশা করি আপনারা এমন কাজ করিবেন না যাহাতে লোক হাসিতে পারে, তাহাকে দিয়া দেশের ও ইসলামের অনেক খেদমত হইবে , আমার মুরীদানদের প্রতি অনুরোধ তাহারা যেন কাজী সাহেব কে জয়যুক্ত করেন।
নির্বাচনের কাজ ও প্রচারণায় অংশগ্রহণে কবি পদে পদে অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হলেও জয়ের বিষয়ে কবি প্রচন্ড আশাবাদী ছিলেন এবং ভোটের কয়েকদিন পূর্বে এক বুক আশা নিয়ে কবি নজরুল পল্লী কবি জসিমউদ্দিন কে বলেন ‘ ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বই ভোট পাবো। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি কিছু পাই তাহলে কেল্লাফতে।’ তবে টাকার অভাবে শেষতক ভোটের বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন কবি। টাকার অভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় পর্যাপ্ত লোকবল ও পাওয়া যায়নি তার পক্ষে।
বস্তুত, বিধান চন্দ্র রায় নজরুলের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ভোটের মাঠে কিন্তু তাঁর জন্য রাখেননি পর্যাপ্ত অর্থ ও লোকবল জোগানোর উপযোগী কোন ব্যবস্থা। কবির বিদ্রোহী কবিতার লাইন, ছন্দ আর গানের সুর বাঙালির মনে মনে গেঁথে থাকলেও ভোটের মাঠে কাজী নজরুল ইসলামকে তোয়াক্কা করেনি সেসময়ের বাঙালিরা। ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল যে পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে নজরুল প্রাপ্ত ভোটে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন এবং ১০৬২ ভোট পেয়ে জামানত হারান, নির্বাচনে ঈসমাইল চৌধুরী ও আব্দুল হালিম গজনভী জয়লাভ করেন।
ভোটের ফলাফলে পরাজিত হলেও তৎকালীন বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান তরুণদের মনে, জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির রাজনীতি , নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জয়লাভের স্বাভাবিক প্রবণতার বিপরীতে পরবর্তীকালের বাংলার রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের জাগরণের ক্ষেত্রে কবি’র উক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল একটি সুদুরপ্রসারি ও তাৎপর্য পূর্ণ অধ্যায়।
সূত্র: বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল–জীবনী, গোলাম মুরশিদ ও জীবনকথা, জসীমউদ্দীন।