নানা অনিয়ম বেরিয়ে আসছে ভিকারুননিসায়

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তদন্তে ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নানা অসঙ্গতি ও অনিয়ম বেরিয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে গঠিত তদন্ত কমিটি ভিকারুননিসার স্কুল ও কলেজ শাখায় অবৈধ ভর্তিবাণিজ্য, শিক্ষকদের বড় অংশের বিরুদ্ধে কোচিং বাণিজ্য, ক্লাসে পাঠদান না করার অভিযোগ তো হরহামেশাই এসেছে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ স্কুল ও কলেজ শাখার গভর্নিং কমিটি দু’টির বিরুদ্ধে নিত্যদিনের। তাদের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে, স্কুল-কলেজকেন্দ্রিক নানা ধরনের বাণিজ্যেরও। যেমন, স্কুল-কলেজের চারটি শাখা মিলে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজ ড্রেসের কাপড় বাণিজ্য, ব্যাজ-আইডি কার্ড বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের আনানেয়ার জন্য পরিচালিত পরিবহন বাণিজ্যসহ নানা ধরনের বাণিজ্যের। এ সবের সাথে গভর্নিং কমিটির সদস্যরা ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন শিক্ষকও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত।

সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর স্কুল শাখার নবম শ্রেণীর ছাত্রী অরিত্রি অধিকারির আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে তদন্ত করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডও তদন্ত করছে। প্রতিষ্ঠান থেকেও পৃথক তদন্ত কাজ চলছে। অভিযোগ ও নানা সময়ে গঠিত কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক নিয়োগে কোনো ধরনের নিয়মকানুন মানা হয় না। রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের বিবেচনাই এখানে প্রধান যোগ্যতা ও বিবেচ্য বলে নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভর্তির জন্য প্রতি বছরই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দেশনা সংবলিত নীতিমালা জারি করা হয়। এ সব কিছুর ‘থোড়াই কেয়ার’ করা হয় এখানে। এ ব্যাপারে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) তদন্ত কমিটি গঠন করে, অভিযোগের সত্যতা পেলেও, আগামীতে এ ধরনের কাজ (আসনের অতিরিক্ত ভর্তি) না করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। এর বাইরে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে।

প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়মের মধ্যে আরো রয়েছে- অনুমোদন ছাড়াই শাখা খোলা, প্রতিটি শ্রেণীতে সেকশন চালু করা, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী নিয়ে গাদাগাদি করে ক্লাস বা শ্রেণীকক্ষ পরিচালনা, আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করানো অন্যতম। এর বাইরেও রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতা বা না থাকা। বালিকা বিদ্যালয়-কলেজ হওয়ার কারণে মেয়েদের জন্য যেসব পারিপার্শ্বিক জরুরি সুবিধা থাকার কথা তার কিছুই নেই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজর কোনো শাখায়। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির মূল (বেইলি রোড়) শাখাসহ ধানমন্ডি, আজিমপুর ও বসুন্ধরা শাখার কোনোটিতেই পর্যাপ্ত টয়লেট ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। তিন শতাধিক ছাত্রীর জন্য মাত্র তিনটি করে টয়লেট রয়েছে প্রতিটি ফ্লোরে। তাও আবার অপরিচ্ছন্ন। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও টয়লেটের দাবি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের। কিন্তু কোনো কিছুতেই গা করে না প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ বা গভর্নিং কমিটি। কয়েক মাস আগে এ ব্যাপারে একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়। বোর্ড একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তারা আজ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

এ প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং কমিটির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের জাতীয় নির্বাচনের মতোই বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় বলে কথা প্রচলিত রয়েছে। বর্তমান সরকারের পরপর দুই মেয়াদে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম আশ্রাফ তালুকদার। এ ছাড়াও স্থানীয় একজন কমিশনারও গভর্নিং কমিটির সদস্য। প্রতিষ্ঠানটির সব বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক এখন এরাই বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান সমস্য ও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগকে দায়ী করেছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজর সাবেক অধ্যক্ষা হামিদা আলী। তিনি বলেন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজর সব সমস্যার জন্য দায়ী ‘বাইরোটেশনে অধ্যক্ষ নিয়োগের নিয়মকে’। তিনি বলেন, একজন ভালো শিক্ষক, যোগ্য প্রশাসক নাও হতে পারেন। প্রতিবারই অস্থিতিশীল-অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখে নানা দিক থেকে চাপে পড়ে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এসব তদন্তে নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি উঠে আসে। কিন্তু দিনশেষে সবগুলোই ধামাচাপা পড়ে যায়। এবারো তাই হচ্ছে কিনা? সময়ই বলবে।

বিশেষ উদ্যোগ শৃঙ্খলা ফেরানোর
ভিকারুননিসার নানা অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা-অসঙ্গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বর্তমান গভর্নিং কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম আশ্রাফ তালুকদার গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, নানা অনিয়ম হতে পারে অতীতে, এ সব অনিয়ম দূর করতে এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, গভর্নিং কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার একজন পূর্ণকালীন অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হবে। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে সংবাদপত্রে। এ ছাড়া সরকারি নিয়োগবিধি অনুসরণ করেই এখন থেকে শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের জন্য এক বা একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি শিক্ষার্থীদেরও দাবি ছিল।

এতদিন অভিভাবকদের অভিযোগ শোনা হতো না বলে স্বীকার করে, গভর্নিং কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম আশ্রাফ আরো জানান, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে। অভিভাবকদের অভিযোগ-সুপারিশ-পরামর্শ নিয়মিতই জানতে চাওয়া হবে। সব শাখায় বাধ্যতামূলকভাবে অভিযোগ বাক্স খোলা হবে। অভিভাবকদের সাথে নিয়মিতই ‘প্যারেন্টস ডে’ চালু করা হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও টয়লেটের দাবি- অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে গোলাম আশ্রাফ তালুকদার বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিষ্কার টয়লেটের জন্য এরই মধ্যে সুইপার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে গভর্নিং কমিটির একাধিক সদস্যের নানা প্রস্তাবও রয়েছে। এগুলো বিবেচনার পাশাপাশি আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছি।

গোলাম আশ্রাফ জানান, আগামীকাল ১৩ ডিসেম্বর গভর্নিং কমিটির বিশেষ জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। এ বৈঠকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ফেরানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে। কিভাবে বাস্তÍবায়ন করা হবে, তাও নির্ধারণ করা হবে। প্রতিষ্ঠানের সুনামের স্বার্থেই এসব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিগত কয়েক দিনে কিছু সমস্যা থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরেছেন। বার্ষিক পরীক্ষা চলছে সুষ্ঠুভাবে।
উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালে তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নূনের সহধর্মিণী ভিকারুননিসা নূনের নামানুসারেই স্কুলটির নামকরণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি সুনামের সাথেই নারী শিক্ষায় অবদান রেখে আসছে আজো।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top