বাংলাদেশের টকজাতীয় ফলের মধ্যে লেবু অন্যতম জনপ্রিয় ফল। দেশে যে ধরনের লেবু পাওয়া যায় তার মধ্যে পাতিলেবু, এলাচিলেবু, কাগজি লেবু উল্লেখযোগ্য। এসব লেবুতে প্রচুর রস থাকে। লেবুর রস নানা গুণে সমৃদ্ধ। লেবুর রস একটি স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিগুণে ভরা একটি পানীয়। মানবদেহ নানা রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা আছে লেবুর রসে। পুষ্টিবিদরা বলছেন, খাবারে যদি অম্লজাতীয় খাবার কম তাকে তাহলে দেহের ওজন বাড়ে। লেবুর শরবত দেহের মেদ কমাতে সাহায্য করে। সুস্থ সুন্দর দেহ গঠনে যেসব খাদ্য উপাদান প্রয়োজন তা লেবুর রসে পাওয়া যায়। তাই প্রতিদিন খাবার টেবিলে লেবু রাখা উচিত। ভাত খাওয়ার সময় লেবুর রস মিশ্রিত করে খেলে খাবারের যেমন স্বাদ বাড়ে তেমনি খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয় দেহ পুষ্টি উপাদানও পায়। দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। ফলে নানা রোগের কবল থেকে দেহ সুস্থ ও সবল থাকে। লেবু সারা বছর বাজারে পাওয়া যায়। দামেও সস্তা। শুধু প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা। পাতি লেবুর বৈজ্ঞানিক নাম Citrus aurantifolia, কাগজি লেবুর বৈজ্ঞানিক নাম Citrus limonis, উদ্ভিদ জগতের Rutaceae গোত্রের উদ্ভিদ।
রাসায়নিক উপাদান : টক স্বাদের গন্ধযুক্ত ফলের রসে অ্যাসকরবিক, সাইট্রিক ও ম্যালিক অ্যাসিড, টার্পিনিন, আলফাপিনিন, বিটা-পিনিন, সাইট্রাল, বায়োফ্লাভোনয়েড, কমারিন, ভিটামিন-এ, বি, লিমোসাইট্রাল, ট্রানজেরিটিন এবয় বিটা- সিটোস্টেরল, ডিলিমোনিন, হেসপিরিডিন, নোবিলোটিন ও সিনেফ্রিন।
পুষ্টি উপাদান : পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী লেবুতে পুষ্টি উপাদান নি¤œরূপ
কাগজি লেবু : জলীয় অংশ ৮৪.৬ গ্রাম, প্রোটিন ২.৪ গ্রাম, চর্বি ২ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.৭ গ্রাম, আঁশ ১.৩ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসার ১০.৯ গ্রাম, শর্করা ১০.৪ গ্রাম, ভিটামিন ৬৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.৩ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৯০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২০ মিলিগ্রাম, লোহা ২.৩ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ৫৯ কিলো ক্যালরি।
এলাচি লেবু : জলীয় অংশ ৮৫ গ্রাম, প্রোটিন ২ গ্রাম, চর্বি ১ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.৩ গ্রাম, আঁশ ১.৭ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট বা শ্বেতসার ১১.১ গ্রাম, ভিটামিন-সি ৪০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১০ মিলিগ্রাম, লোহা ২.৩ মিলি গ্রাম, খাদ্যশক্তি ৫৯ কিলো ক্যালরি।
পুষ্টিবিদদের মতে, আমাদের হাটবাজারে যেসব লেবু পাওয়া যায় তার ওজন সাধারণত ৫০-৬০ গ্রাম হয়ে থাকে। এই ৬০ গ্রাম ওজনের একটি লেবুতে পুষ্টি উপাদান হলো ভিটামিন সি ২৮.৬ মিলিগ্রাম, সাইট্রিক এসিড ২.৮৫ মিলিগ্রাম, ফোলেট ৭.৯৩ মাইক্রোগ্রাম, প্রোটিন ০.২৩ গ্রাম, শ্বেতসার ৫.২৬ গ্রাম, বিটা ক্যারোটিন ১.৮৩ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন এ ১২.২০ মাইক্রোগ্রাম, কোলিন ৩.১১ মিলিগ্রাম, বায়োট্রিক ০.১৮ মাইক্রোগ্রাম, লুটিন স্পাজিয়াক্সথিন ৪.৪৯ মাইক্রোগ্রাম, আলফা টোকোফেরল (ভিটামিন-ই) ০.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-বি ০.০২ মিলিগ্রাম, বি২ ০.০১ মিলিগ্রাম, বি৩ ০.০৬ মিলিগ্রাম, বি৬ ০.০৩ মিলিগ্রাম, কপার ০.০২ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.০২ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪.২৭ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৩.৬৬ মিলিগ্রাম, পটাসিয়াম ৭৫.৬৪ মিলিগ্রাম, খাদ্যশক্তি ১৫.২৫ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩.৬৬ মিলিগ্রাম, খাদ্য আঁশ ০.২৪ গ্রাম।
ওষুধি গুণাগুণ : খাদ্য পরিপাকে লেবু খুবই কার্যকর। হজম হওয়ার পর লেবুর রস অ্যালকালাইন রিÑ অ্যাকশন তৈরি করে পাকস্থলির খাদ্য হজমে সাহায্য করে। যারা গ্যাস্ট্রিক রোগে ভুগছেন তারা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানিতে অর্ধেকটা লেবুর রস মিশিয়ে খান সপ্তাহ খানেক। সমস্যা কমে আসবে। লেবুতে সাইট্রিক এসিড থাকায় দেহ থেকে ক্যালসিয়াম নির্গমন কমিয়ে দিয়ে পাথুরে রোগ প্রতিহত করে। শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে প্রতিদিন সকাল-বিকাল লেবুর রস দিয়ে শরবত তৈরি করে পান করুন। লেবুর ভিটামিন-সি দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং অতি দ্রুতগতিতে কোলাজেন কোষ তৈরি করে ফলে দেহের কাটা ও ক্ষত স্থান শুকিয়ে যায়। কারো যদি কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে অর্থাৎ পায়খানা শক্ত হয় বা দু-এক দিন পরপর হয়। তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা বা অর্ধেকটা লেবুর রস এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে (চিনি বা লবণ ছাড়া) পান করুন এবং রাতে ঘুমানোর আগে লেবুর রসের শরবত খেয়ে নিন সমস্যা কমে আসবে।
এভাবে কয়েক দিন খেতে হবে। লেবুর খোসায় প্রচুর পরিমাণে বায়ো ফ্লাভোনয়েড থাকে যা দেহে ক্যানসার কোষ তৈরি বা বিস্তারে বাধা দেয় লেবুর রসে প্রচুর ভিটামিন-সি থাকায় দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয় এবং ধমনীর স্থিতিস্থাপকতার অবস্থা ও দৃঢ়তা বজায় থাকে ফলে রক্ত সঞ্চালনের পথ সুগম রাখে। হৃদরোগের সম্ভাবনা কমে যায়। লেবুর খোসায় সালভাস্টোল ৪০ কিউ এবং লিমোনিন থাকে। যা দেহে ক্যানসার প্রতিরোধে বিরাট ভূমিকা রাখে। লেবুর খোসাতে থাকে পলিফেনল ফ্লাভনয়েড, যা দেহের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য থাকে। ভালো কোলেস্টরলে তৈরি করে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপ্রেসার আছে তারা নিয়মিত লবণ ছাড়া লেবুর শরবত খান। লেবুর রস শরীরে প্রবেশের পর অম্লীয় বা এসিড থেকে ক্ষারীয় হয়ে রক্তে মিশে যায়। ফলে শরীরের অম্লতা ও ক্ষারের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং পিএইচর মাত্রা ঠিক থাকে। লেবুর শরবত লিবার বা যকৃত বা কলিজাকে শুদ্ধ করে এবং শরীরের উৎপন্ন টক্সিন বের করে দেয়। ফলে হজমশক্তি ভালো থাকে, শরীর সুস্থ সবল থাকে। লেবুর পটাসিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুকে সক্রিয় রাখে। লেবুতে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট চামড়ার বলিরেখা এবং ব্রণ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া দূর করে।
চোখের চার পাশের কালো দাগ দূর করে। চামড়ার নতুন নতুন কোলাজেন কোষ তৈরি করে। ফলে চামড়ার উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। যাদের মুখে দুর্গন্ধ হয় তারা লেবুর রস দিয়ে শরবত খান এবং সম্ভব হলে খোসা বা চামড়া চিবিয়ে খান। দুর্গন্ধ থাকবে না। এতে দাঁতের ব্যথা, মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়, দাঁতের প্লাক জমার কারণে যে দাগ পড়ে তাও কমে আসবে। মানসিক চাপে ভুগলে শরীরে ভিটামিনসির ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মানসিক চাপ বাড়ে। তাই যারা মানসিক চাপে ভোগেন তারা সকাল বিকাল লেবুর শরবত খান।
মানসিক চাপ কমবে। যাদের শরীরের ওজন বয়সের তুলনায় বেশি তারা (চিনি বা লবণ ছাড়া) লেবুর শরবত খান ওজন কমে আসবে। কারণ লেবুর ফ্যাট বানিং এনজাইম শ্বেতসার সুগার শোষণ করে ওজন কমিয়ে দেয়। লেবুর রস রক্তের লোহিত কণিকাকে টক্সিন ও অন্যান্য দূষিত পদার্থের হাত থেকে রক্ষা করে বিশুদ্ধ রক্ত পরিবহনে সাহায্য করে। ঘুম থেকে উঠেই অলস অলস ভাব ও শরীরে ব্যথা ভাব মনে হলে ঘুম থেকে উঠেই এক গ্লাস লেবুর শরবত খেয়ে নিন। সমস্যা থাকবে না। লেবু হাড়ের জোড়া জোড়া হতে ইউরিক এসিড দূর করতে সাহায্য করে। এ ইউরিক এসিডই দেহে বিষ ব্যথা সৃষ্টি করে।
সর্তকতা : লেবু কেটে সরাসরি কামড়িয়ে খাবেন না। এতে দাঁতের এনামেলের ক্ষতি করে। যাদের কিডনি বা গলব্লাডারের সমস্যা আছে তারা লেবুর খোসা খাবেন না। যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়বেটিস আছে তারা লেবুর রসের সাথে লবণ এবং চিনি মিশিয়ে খাবেন না। যাদের শরীরে স্বাস্থ্য বেশি তারা লেবুর শরবতে চিনি মিশাবেন না। যদি কারো লেবুর শরবত খেলে শরীরে সমস্যা হয় বা যারা রোগী তাদের সমস্যা হলে লেবু খাবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। কোনো অবস্থাতেই শুধু লেবুর রস খাবেন না বা শরীরে কোনো অংশে লাগাবেন না। বেশি সময় লেবু কেটে রাখবেন না। তাড়াতাড়ি খাওয়া উচিত। অত্যন্ত উপকারী এই ফলগাছটি বাড়ির আশপাশে লাগান যত্ন নিন। তাতে যে ফল আসবে তাতে পরিবারের চাহিদা মিটিবে।
লেখক : শিক্ষক, কলাম ও স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক