সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, অসুস্থ হওয়ার পরও আমাকে চিকিৎসা করতে বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এভাবে আমাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না, এগিয়ে যাব৷ আমার বয়স হয়েছে, চিকিৎসা করতে দেবে না, বাইরে যেতে দেবে না। মৃত্যুর আমি ভয় করি না।
বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ করেই বনানীর নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে এসে গাড়ি থেকে না নেমেই নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি এসব বিস্ফোরক মন্তব্য করেন।
নির্বাচন সামনে রেখে পার্টির মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরুর পর কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না এরশাদকে। তার অসুস্থতার বিষয়ে জাতীয় পার্টির এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দেয়া হচ্ছিল সাংবাদিকদের।
এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ করেই বনানীর নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে এসে গাড়ি থেকে না নেমে নেতাকর্মীদের সামনে কয়েক মিনিট কথা বলেন এরশাদ। তিনি বলেন, আজ বলতে এসেছি, আমাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না, এগিয়ে যাব। দলের নতুন মহাসচিবকে সহায়তা ও তার নির্দেশনা মেনে দলকে আরো গতিশীল করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়ে এরশাদ বলেন, আমি বেঁচে আছি, ভালো আছি। তোমরা ঐক্যবদ্ধ থেকে দলকে শক্তিশালী করো। আমরা নির্বাচনে যাবো, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অনেক ভালো করবে। দলকে বিজয়ের পথে নিয়ে যাবো আমরা। তোমরা জাতীয় পার্টির পতাকাতলেই থেকো, কেউ যেন দল না ছাড়ে তিনি সে আহবানও জানান। যদিও এরআগে বনানী অফিসে সংবিধান সংরক্ষণ দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় মোবাইল ফোনে সাবেক রাষ্ট্রপতি পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, জাতীয় পার্টি এখন কঠিন সময় পার করছে, আমরা ভেঙে পরিনি। আগামীতে হয়তো আরো কঠিন সময় পার করতে হবে। সেজন্য জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কেউ যেন দল ছেড়ে যেওনা, কেউ নিরুৎসাহিত হইওনা। সবাই এমপি হতে পারেনা, সবাইকে দলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কারন, সুদিন আমাদের আসবেই। ভালো থেকো, সবাই।
এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়ে এরশাদ নাটকীয় অসুস্থতা নিয়ে সিএমএইচে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে ভর্তি থাকা অবস্থাতেই তিনি এমপি নির্বাচিত হন এবং পরে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পান। এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে ‘অসুস্থ’ এরশাদের সিএমএইচে ভর্তির খবর এলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
এদিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবিধান সংরক্ষণ দিবসের এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের। সভায় প্রেসিডিয়াম সদস্য নূর-ই হাসনা লিলি চৌধুরী, সুনীল শুভ রায়, এস.এম. ফয়সল চিশতী, উপদেষ্টা এ্যাড. রেজাউল ইসলাম ভূঁঞা, ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, যুব সংহতির সাধারণ সম্পাদক ফখরুল আহসান শাহজাদা, স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সদস্য সচিব বেলাল হোসেন, শ্রমিক পার্টির সভাপতি একেএম আশরাফুজ্জামান খান, ছাত্রসমাজের আহ্বায়ক মোড়ল জিয়া প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু, প্রফেসর মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, এটিইউ তাজ রহমান, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, উপদেষ্টা একেএম মোস্তাফিজুর রহমান, মোঃ নোমান, মোঃ সেলিম উদ্দিন, নাজমা আখতার, একেএম মোস্তাফিজুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরু, অধ্যাপক আবুল হোসেন, নুরুল ইসলাম মিলন, আলহাজ্ব শওকত চৌধুরী, সরদার শাহজাহান, আতাউর রহমান আতা, হেনা খান পন্নি, যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক, এ্যাড. তোফাজ্জল হোসেন, নুরুল ইসলাম ওমর, সালাউদ্দিন মুক্তি, জহিরুল আলম রুবেল, শফিকুল ইসলাম শফিক, সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান আহমেদ সেলিম, মুনিম চৌধূরী, হেলাল উদ্দিন, আমিনুল ইসলাম ঝন্টু, মোস্তাফিজুর রহমান নাঈম প্রমুখ।
জিএম কাদের বলেন, পার্টি চেয়ারম্যান ডাক্তারের পরামর্শেই আছেন। মেডিকেল বোর্ড মনে করলে, তিনি সিঙ্গাপুরেই চিকিৎসা নেবেন। এরশাদ রাজনীতিতে আছেন- তিনিই জাতীয় পার্টি পরিচালনা করছেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ সকল সিদ্ধান্তই এরশাদ নিচ্ছেন। স্বাধীনভাবেই তিনি রাজনীতি করছেন এবং দল পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, এরশাদকে যারা ক্ষমতা প্রয়োগকারী বলেছে, তারাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এর ক্ষমতার সাথে পার্টির প্রধান হয়ে পরবর্তীতে আরো বেশি ক্ষমতা অপব্যাবহার করেছেন। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য শেষ হয়ে গেছে। যারা এরশাদের শাসনামলকে নিন্দাবাদ করেছেন, তারা বুকের ওপর হাত দিয়ে বলতে পারবেন না, এরশাদ পরবর্তী সময়গুলো দেশের ভালো কেটেছে। তিনি বলেন, এখন মূল্যায়নের সময় এসেছে, এরশাদের শাসনামল নাকি পরবর্তী সরকারগুলোর শাসনামলে দেশ ভালো চলেছে।
জিএম কাদের বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন বয়োজেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, তাঁর দেশ পরিচালনার দক্ষতা ও ক্ষমতা আছে। তাই দেশের মানুষ এখনো তার শাসনামলে ফিরে যেতে চায়। দেশের মানুষ এখনো তাকে ভালোবাসেন। কিন্তু যারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বি তারা শুধু এরশাদেই ভয় পায়। কারন, তিনি সঠিক সময়ে, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জিএম কাদের বলেন, কেউ যদি দলের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায় তা বরদাশ করা হবেনা। জাতীয় পার্টি এগিয়ে যাওয়া মানেই দেশের গণতন্ত্র সমুন্নত হওয়া। জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হলেই দেশের সংবিধান সুসংহত হয়।
মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, জাতীয় পার্টি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়। জাতীয় পার্টি চায় সাধারন মানুষ যেন নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। ভোট ডাকাতি ও ব্যালট ছিনতাই জাতীয় পার্টি বিশ্বাস করেনা। নির্বাচন প্রসঙ্গে রাঙ্গা বলেন, জাতীয় পার্টি ১৪ দলের সাথে অংশ নিয়ে মহাজোটের মাধ্যমে নির্বাচন করবে। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি সাংবাদিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করেছে। এবার আপনারা আমাদের পাশে থাকুন, আমাদের সাহায্য করুন। আমরা লাঙ্গলকে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে চাই।
পার্টি চেয়ারম্যানের প্রতি জুলুম ও নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে পার্টির মহাসচিব রাঙ্গা বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতিকে ১২দিন মাটিতে ঘুমাতে হয়েছে। বিনা বিচারে ৭ বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। যারা এরশাদের প্রতি অবিচার করেছে, আজ তারাই কারাগারে দিন পার করছে। যারা র্যাব দিয়ে মানুষ খুন করেছে, অপারেশন ক্লিনহাটের নামে মানুষ হত্যা করেছে তারাই আজকে মানুষ খুনের ধুয়া তুলছে। তিনি বলেন, নতুন করে মহাসচিবের দায়িত্ব নেয়ার পর এখন এক মাসেরও কম সময় আছে।
তারপরও আমরা আগামী প্রজন্মেও জন্য বাসযোগ্য একটি দেশ গড়তে চাই। দলকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে নবনিযুক্ত মহাসচিব বলেন, এখন থেকে প্রতিদিনই দলীয় এমপি ও মন্ত্রীরা বনানী এবং কাকরাইল অফিসে সময় দেবেন। দলের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত এবং উজ্জীবিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে। শুধু ঢাকায় সময় দিলেই হবেনা, দেশের তৃণমূলে সফর করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।