টাঙ্গাইল শাড়িকে বিখ্যাত করেছিলেন নির্মল ঠাকুর, পাশে দাঁড়িয়েছিলেন উত্তমকুমার। তৎকালীন বাংলা সিনেমায় এমন একজনও নায়িকা ছিলেন না, যিনি পর্দায় নির্মল ঠাকুরের শাড়ি পরেননি।
“যদি হই চোর কাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে, দুষ্টু যে হয় এমন কাজ তো তারই সাজে…।”
মহানায়ক উত্তমকুমারের লিপে কিশোরকুমারের গাওয়া ‘অমানুষ’ ছবির গানটা শুনেছেন? শর্মিলা ঠাকুর সেই দৃশ্যে ‘ডবি’ নক্সায় বোনা হলুদ রঙের যে তাঁতের শাড়িটা পরেছিলেন, সেটি কার জানেন?
কিংবা, “এ বার মলে সুতো হবো, তাঁতির ঘরে জন্ম লবো, পাছা পেড়ে শাড়ী হয়ে দুলবো তোমার কোমরে, তোমরা যে যা বল আমারে…।” মৌচাক সিনেমায় উত্তমকুমারের লিপে মান্না দে’র গাওয়া এই গানটি হয়ত শুনেছেন। ওই দৃশ্যে সাবিত্রী যে শাড়িটি পরেছিলেন, সেটির স্রষ্টা কে জানেন? তাঁর নাম নির্মল ভট্টাচার্য্য। ধাত্রীগ্রামের সবাই যাঁকে চেনেন নির্মল ঠাকুর নামে।
তৎকালীন বাংলায় সিনেমায় এমন একজনও নায়িকা ছিলেন না, যিনি পর্দায় নির্মল ঠাকুরের শাড়ি পরেননি। সুচিত্রা, সুপ্রিয়া, সাবিত্রী, সুব্রতা থেকে শুরু করে হিন্দি ছবির ‘হার্ট থ্রব’ শর্মিলা ঠাকুর, কিংবদন্তী বৈজয়ন্তীমালাও পর্দায় ও পর্দার বাইরে পরতেন নির্মল বাবুর শাড়ি। যাঁর ‘ধাক্কা’ পাড়ের ধুতি পরে পর্দায় দেখা দিতেন মহানায়ক উত্তমকুমার, সৌমিত্র, কালী ব্যানার্জি, তরুণকুমার, রঞ্জিত মল্লিক থেকে মুম্বাইয়ের গায়ক নায়ক বিশ্বজিৎও। তাঁর কাছ থেকে সিনেমার দৃশ্যে ব্যবহার করার জন্য শাড়ি কিনতেন সুখেন দাস থেকে সত্যজিৎ রায়।
ইতিহাসের সন্ধানে ধাত্রীগ্রামে
ধাত্রীগ্রামের নিজের বাড়ির দোতলার ঘরে বসে, স্মৃতি হাতড়ে চলেছিলেন বাহাত্তর বছরের নির্মলবাবু। ১৯৯২ সালে স্পাইনাল কর্ডে ধরা পড়েছিল ‘প্লাজমা সাইটোমা’। ২৮ বছর ধরে ক্যানসারের যন্ত্রণা ভোগ করছেন। কিন্তু আজও বেঁচে আছেন বিস্ময়কর এক জীবনীশক্তি নিয়ে। চলছে কড়া ওষুধ, বাড়িতে সর্বক্ষণের জন্য মজুদ রাখা হয় অক্সিজেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। মাঝে মাঝেই ফিকে হয়ে যাচ্ছিল স্মৃতি। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার কোকডহরা’তে (উতরাই) ছিল নির্মলবাবুদের আদি বাড়ি। বাংলাদেশে তাঁর বাবা মণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ছিল ‘বান্ধব প্রেস’। বেশ সচ্ছল ছিল পরিবারটি।
কিন্তু, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অত্যাচারে পূর্ব-পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) ছেড়ে ১৯৫৬ সালে ভারতে এসেছিলেন মণীন্দ্রনাথ। স্ত্রী, তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে। নির্মলবাবুর বয়েস তখন প্রায় সাত। প্রথমে পায়রাডাঙ্গা, তারপর অশোকনগর, সব শেষে পরিবারটি থিতু হয় বর্ধমানের ধাত্রীগ্রামে। সালটা ছিল ১৯৬২। বাংলাদেশ থেকে অর্থ আনলেও কিছু অসাধু মানুষের প্রতারণায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল পরিবারটি। স্বচ্ছলতার রোশনাই থেকে দারিদ্রের অন্ধকারে এসে হাঁফিয়ে উঠতেন নির্মল।
অভাবে কারণেই পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মেধাবী নির্মলের। পেটের তাগিদে অল্প বয়েসেই নামতে হয়েছিল পথে। নির্মলের মা বাড়িতে কয়লার উনুনে বানিয়ে দিতেন হাত-রুটি, তরকারি, ডিম সেদ্ধ। কাটোয়া লাইনের ট্রেনে সেগুলি বিক্রি করতেন কিশোর নির্মল। এমন ভাবেই কোনও মতে চলছিল দিন গুজরান।
অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন নির্মল
ধাত্রীগ্রামে তখন বাংলাদেশ থেকে আসা তন্তুবায়দের বাস। তাঁরা টাঙ্গাইল শাড়ি বোনেন। কিন্তু খুবই অল্পদামে বিক্রি হয়। তবুও কোনও মতে সংসার চলে যায়। বাঁচার তাগিদে নির্মল ভেবেছিলেন তাঁত বোনা শিখবেন।কিন্তু বামুনের ছেলেকে কেউ তাঁত বোনা শেখাতে চাননি, পাপ হবে ভেবে। নাছোড়বান্দা নির্মলবাবু তাঁত বোনা শিখেছিলেন শান্তিলাল বসাকের কাছ থেকে। শান্তিলালবাবুও ছিলেন ময়মনসিংহের একই গ্রামের মানুষ।
মুলিবাঁশ আর বেড়া দিয়ে তৈরি করা বাড়িতে নিজের তাঁত বসিয়েছিলেন নির্মলবাবু। জন্ম নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ ঘরে, হয়ে গিয়েছিলেন পেশাদার তন্তুবায়। বুনতে শুরু করেছিলেন অনবদ্য টাঙ্গাইল শাড়ি। নিজে হাতে তাঁত বুনেছেন প্রায় ১০ বছর। টাঙ্গাইল শাড়িতে তিনি এনেছিলেন অসাধারণ বৈচিত্র। পাটলি পাল্লু, গিলা বুটি, মুগা ডুরে, মীরা নামের শাড়িগুলি যেন প্রাণ পেত নির্মল বাবুর হাতে। নিজের হাতে শাড়ি বুনতে গিয়ে দেখেছিলেন, এলাকায় শাড়ি বিক্রি করে দাম পাওয়া যাবে না। দাম পেতে গেলে ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইলকে সর্বভারতীয় স্তরে জনপ্রিয় করতে হবে।
তাই একদিন ১৭টি শাড়ি নিয়ে নির্মলবাবু পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়।দিনের বেলা বাড়ি বাড়ি, অফিসে অফিসে ঘুরে শাড়ি বিক্রির চেষ্টা করতেন। রাতে ম্যাডক্স স্কোয়ারে শুয়ে থাকতেন ছাতু খেয়ে। তখন নকশাল আমল। অবিবাহিত পুরুষদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতেন না। শ্যামবাজারের এক প্রেসে, নির্মলবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসের স্ত্রী লাবণ্যপ্রভার। বাবা মণীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে। লাবণ্যপ্রভা দেবী লেক টেরেসে যেখানে থাকতেন, সেই বাড়িতেই নির্মলবাবুর ভাড়া থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ভাড়াবাড়িতেই নির্মলবাবু তৈরি করেছিলেন তাঁর নিজের শো রুম ‘উপহার’।
টাঙ্গাইল শাড়িতে দক্ষিণ ভারতের পাটলি-পাল্লু ডিজাইন আনার মূল কৃতিত্ব কিন্তু নির্মল বাবুর। এই শাড়িগুলির কুঁচি ও আঁচল ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের হত। আরেকটি অসামান্য কৃতিত্ব আছে নির্মল বাবুর। তাঁতের শাড়ি যে একশো টাকার বেশি দামে বিক্রি করা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সর্বপ্রথম তিনিই সেটা প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইল শাড়িকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন রুপালী পর্দায় এনে।
পাশে দাঁড়িয়েছিলেন উত্তম কুমার
জ্যাঠা অবিনাশ ভট্টাচার্য্য ছিলেন স্টার থিয়েটারের ম্যানেজার। তাঁর সূত্রেই নির্মলবাবুর পরিচয় হয়েছিল রূপোলি পর্দার নায়ক, নায়িকা, পরিচালকদের সঙ্গে। তখনকার দিনে সিনেমার পর্দায় নায়ক নায়িকাদের পরা পোশাক, বাজারে এলেই সুপারহিট হয়ে যেত। দোকানে দোকানে ভিড় পড়ে যেত সেই পোশাক কেনার জন্য। নির্মলবাবু বুঝেছিলেন ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইল শাড়িকে বিখ্যাত করতে গেলে, সিনেমার পর্দায় নায়িকাদের অঙ্গে ওঠাতেই হবে টাঙ্গাইল শাড়ি।
শুরু হয়েছিল শাড়ির গাঁট নিয়ে নায়ক, নায়িকা, পরিচালকদের বাড়ি আর স্টুডিওতে ঘোরা। নির্মলবাবুর চেষ্টা সফল হয়েছিল। তাঁর শাড়ির অনন্য বৈচিত্র ও সৌন্দর্য্য দেখে প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মেজদা ওরফে উত্তমকুমার। আর ফিরে তাকাতে হয়নি নির্মলবাবুকে। একের পর এক সুপারহিট ছবিতে নায়িকাদের অঙ্গে উঠতে থাকে নির্মল ভট্টাচার্যের টাঙ্গাইল শাড়ি।
উত্তমকুমারে প্রায় পারিবারিক সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন নির্মলবাবু। উত্তমের ময়রা স্ট্রিট ও গিরীশ মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়মিত ছিল যাওয়া আসা। উত্তমকুমারের মৃত্যুর আগের দিনেও উত্তমকুমারের বাড়ি শাড়ি দেখাতে গিয়েছিলেন নির্মলবাবু। নির্মলবাবুকে খুব ভালোবাসতেন সুপ্রিয়া দেবীও। না খাইয়ে ছাড়তেন না। নির্মলবাবুর এখনও মনে পড়ে, উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া ও সত্যজিৎ রায় খেতে ভালোবাসতেন ধাত্রীগ্রামের ‘পোড়াবাড়ির’ চমচম। টিনে করে এনে দিতেন নির্মলবাবু। দাম কিন্তু সবাই দিয়ে দিতেন। নিতে না চাইলে বরং রাগ করতেন।
নির্মল ঠাকুরের স্মৃতি থেকে উঠে এসেছিল আমাদের অজানা কিছু দৃশ্য
একবার, উত্তমকুমার যাচ্ছিলেন কাটোয়ার দিকে শুটিং করতে। নির্মলবাবু সেদিন কলকাতা থেকে ধাত্রীগ্রাম ফিরবেন। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে হাওড়া গিয়ে সেই ট্রেনটি ধরেছিলেন। ব্যান্ডেলে গাড়ি থেমেছিল। নির্মলবাবু নিজের কামরা থেকে দৌড়ে উত্তমকুমারের কামরার দরজার কাছে গিয়েছিলেন। উঠতে দেয়নি পুলিশ। নির্মলবাবু পুলিশকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের সর্বক্ষণের সঙ্গী বংশীকে একবার ডেকে দিতে। বংশী এসে বলেছিলেন, কামরায় উঠতে দেবে না পুলিশ। হতাশ হয়ে নিজের কামরায় ফিরে এসেছিলেন নির্মলবাবু।
কয়েকটি স্টেশন পরে আবার বংশীই এসে হাজির হয়েছিলেন নির্মলবাবুর কম্পার্টমেন্টে। বলেছিলেন,উত্তম কুমার ডাকছেন। নির্মলবাবুকে দেখে উত্তমকুমার অবাক হয়ে বলেছিলেন,
–কিরে নির্মল, তুই এই ট্রেনে!
-এ তো আমার রোজের কাহিনী দাদা।
-এত কষ্ট করিস তুই!
অবাক বিস্ময়ে নির্মলবাবুর দিকে তাকিয়েছিলেন মহানায়ক। পাশাপাশি বসে দুজনে ধাত্রীগ্রাম পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ধাত্রীগ্রাম স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগে নির্মলবাবু উত্তমকুমারকে অনুরোধ করেছিলেন, “দাদা একবার ধাত্রীগ্রামের মাটিতে পায়ের ধুলো দিন।” কথা রেখেছিলেন উত্তমকুমার। ধাত্রীগ্রাম স্টেশনে নেমে ছিলেন মহানায়ক, কয়েক মিনিটের জন্য।
একবার নির্মলবাবু, বেঙ্গল হোম ইন্ড্রাস্ট্রিজে গিয়েছিলেন শাড়ির গাঁট নিয়ে। সেখানকার ম্যানেজার তাঁর যাওয়ার খবর পেয়ে বলেছিলেন, “নির্মল, শাড়িগুলো নিয়ে ভেতরে এসো।” ম্যানেজারের ঘরের ভেতরে বসে একজন মহিলা শাড়ি দেখছিলেন। ম্যানেজারের মুখে ‘নির্মল’ নামটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়েছিলেন ‘ম্যাডাম’। বাঙালির হৃদয় তোলপাড় করা ভঙ্গিতে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন “তুমি এখানে নির্মল?” মহানায়িকা সুচিত্রা সেন জেনে অবাক হয়েছিলেন, এতদিন নির্মলের শাড়িগুলিই তিনি বেঙ্গল হোম ইন্ড্রাস্ট্রিজ থেকে বেছে বেছে কিনে নিয়ে যেতেন।
বৈজয়ন্তীমালার ভগ্নিপতির বেলভেডিয়া রোডের বাড়িতেই দেখা হয়েছিল, বলিউডের মহানায়িকা বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে। তিনি ও তাঁর স্বামী ডঃ বালি খুবই পছন্দ করতেন নির্মলবাবুকে। বৈজয়ন্তীমালা পছন্দ করতেন, ‘গিলা’ আর ‘কাঁকড়া’ বুটির টাঙ্গাইল শাড়ি। সে শাড়ি কোঠারি মিলের ২২০০ সানা, ১০০/২ কাউন্টের বিশেষ সুতো দিয়ে বোনা হত। মুম্বাইতে বৈজয়ন্তীমালার বাড়িতে স্ত্রী সুচিত্রা ও শিশুপুত্র সুকান্তকে নিয়ে গিয়েছিলেন নির্মলবাবু। দিনটি ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর। তাই সবাইকে নিজের হাতে কেক খাইয়েছিলেন বৈজয়ন্তীমালা।
ভারত বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইল শাড়ি
একে একে কলকাতার সব বিখ্যাত চিত্রপরিচালক সিনেমার শ্যুটিং-এ নির্মলবাবুর শাড়ি নিতে শুরু করেছিলেন। শাড়ি নিতেন খোদ সত্যজিৎ রায়ও। থিয়েটারের প্রয়োজনেও টাঙ্গাইল শাড়ি সরবরাহ করতেন নির্মলবাবু। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হিট বাংলা সিরিয়ালেও তাঁর শাড়ি পরেই অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া দেবী। একসময় কলকাতার বহু সম্ভ্রান্ত ও বনেদি পরিবারের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট ছিল নির্মলবাবুর শাড়ি।
রাজ্য সরকারের তন্তুজ, তন্তুশ্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বেঙ্গল হোম ইন্ডাস্ট্রিজ, মঞ্জুষা ইত্যাদি সংস্থায় ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রির নেপথ্যে ছিলেন এই মানুষটি। ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইল শাড়ি শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এই অক্লান্ত মানুষটির হাত ধরেই। ক্যানসার ধরা পড়বার পরেও ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দুই ছেলে এক মেয়ে তখন স্কুলে পড়ে। ব্যবসার হাল ধরার চেষ্টা করেছিলেন স্ত্রী সুচিত্রা ভট্টাচার্য। কিন্তু রোগাক্রান্ত স্বামী ও ছেলে মেয়েদের সামলে ব্যবসা দেখা আর সম্ভব হয়নি না। শাড়ির ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ২০০৫ নাগাদ।
রুপোলী পর্দার কত বিখ্যাত নায়ক নায়িকার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু একটার বেশি ছবি ধরে রাখতে পারেননি কেন? প্রশ্নটি শুনে ম্লান হেসেছিলেন নির্মল বাবু, বলেছিলেন,“আমার তখন ক্যামেরা ছিল না বা ছবি তোলার মানসিকতাও ছিলো না। আমার মূল লক্ষ্য ছিল ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইল শাড়ি জনপ্রিয় করা। কারণ আমার ওপর নির্ভর করে থাকতেন ধাত্রীগ্রামের অনেক মানুষ ও তাঁদের পরিবার।”
উঠে আসার আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোনও আশা অপূর্ণ থেকে গেল নির্মল বাবু? আমার দিকে একবার তাকিয়ে খাট থেকে নেমে ক্রাচ নিয়ে আস্তে আস্তে জানলার কাছে গিয়েছিলেন নির্মল ঠাকুর।
জানলার গ্রিল ধরে অস্ফূটে বলেছিলেন, “আমার কিছুই চাই না, শুধু ওপারের টাঙ্গাইল বাঁচুক এপারেও।” তারপর খোলা জানালাটার বাইরে চোখ মেলেছিলেন।
বুঝতে পারছিলাম, ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠছিল বিচ্ছিন্ন শব্দের দল। উত্তম..সুচিত্রা… সুপ্রিয়া.. সাবিত্রী.. সৌমিত্র….বনপলাশের পদাবলী…মৌচাক… অমানুষ….অরণ্যের দিনরাত্রি….সত্যজিৎ….. গিলাবুটি…মুগা ডুরে…বাংলাদেশ… আরও কত শত। বুঝতে পারছিলাম নির্মল বাবুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। যেমন ঝাপসা হয়ে আসছিল জানলার বাইরেটাও, হঠাৎ নেমে আসা কুয়াশায়।