কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস অন্তত ৩০ মিনিট বাতাসে থাকতে পারে এবং ৪.৫ মিটার (প্রায় ১৫ ফুট) পর্যন্ত যেতে পারে, যা বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষগুলো পরামর্শ দিয়ে আসছে, তার চেয়ে অনেক বেশি। চীনা সরকারের রোগতত্ত্ববিদদের একটি দলের সমীক্ষায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সমীক্ষায় যানবাহনে চড়া ও লোক সমাগমপূর্ণ স্থানে যাওয়ার সময় মাস্ক পরার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
গবেষকেরা আরো দেখতে পেয়েছেন যে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে যেখানে ফোঁটা পড়ে, সেখানে ভাইরাসটি কয়েক দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। এর ফলে অসচেতন কোনো লোক এটি স্পর্শ করে তার মুখমণ্ডল স্পর্শ করলে তার দেহেও তা প্রবেশ করার ঝুঁকি থাকে।
কোনো স্থানে ভাইরাসটি পড়লে তা কতক্ষণ টিকে থাকবে তা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তাপমাত্রা ও যে স্থানে সেটি পড়ে তার ওপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (৯৮ ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় জীবাণুটি কাচ, কাপড়, ধাতু, প্লাস্টিক বা কাগজের ওপর দুই থেকে তিন দিন টিকে থাকতে পারে।
হুনান প্রদেশের সরকারি গবেষকেরা এক গুচ্ছ ঘটনা তদন্ত করে এসব বিষয় দেখতে পেয়েছেন। অথচ বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষগুলো বলে আসছিলেন, নিরাপদ দূরত্ব হলো এক থেকে দুই মিটার (তিন থেকে সাড়ে ছয় ফুট)। হুনানের গবেষকদের এই তথ্য স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করল।
হুনানের গবেষকেরা ২২ জানুয়ারি চান্দ্র নববর্ষে সর্বোচ্চ পর্যটন মওসুমে স্থানীয় একটি প্রাদুর্ভাবের ঘটনার ভিত্তিতে ওই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ‘ক’ নামে পরিচিত এক যাত্রী দূরপাল্লার একটি পুরো ভর্তি বাসে চড়ে পেছন দিক থেকে দ্বিতীয় সারিতে বসেন।
ওই যাত্রী বাসে চড়ার আগেই অসুস্থ অনুভব করছিলেন। তবে তখনো করোনাভাইরাসকে চীনা কর্তৃপক্ষ জাতীয় সঙ্কট হিসেবে ঘোষণা করেনি। ফলে ‘ক’ মাস্ক পরেননি, কিংবা ৪৮ আসনের বাসের বেশির ভাগ যাত্রী বা চালকও তা পরেননি।
চীনে সব দূর পাল্লার বাসে (এসব বাসের সব জানালা বন্ধ থাকে) ক্লোসড সার্কিট টেলিভিশন ক্যামেরা বসাতে হয়। তা থেকেই গবেষকেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে ভাইরাসটি কিভাবে ওই বাসে ছড়িয়ে পড়ল, সেই কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে।
গবেষকেরা শুক্রবার জার্নাল প্রাকটিক্যাল প্রিভেন্টিভ মেডিসিনে তাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, এয়ার কন্ডিশনের মধ্যে বদ্ধ পরিবেশে নতুন করোনাভাইরাসটি সাধারণভাবে ঘোষিত নিরাপদ দূরত্বের চেয়ে বেশি দূর ছড়াবে, তা স্বাভাবিক।
গবেষণাপত্রে আরো বলা হয়, বাহক বাস ত্যাগ করার পরও ভাইরাসটি বাতাসে থেকে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে করোনাভাইরাস মানুষের মুখে বা দৈহিক তরলে ৫ দিনেরও বেশি সময় টিকে থাকতে পারে।
তারা বলেন, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে হাত ধোয়া ও জনসমাগমপূর্ণ স্থানে মাস্ক পরা খুবই দরকার। কারণ ভাইরাস অতি ক্ষুদ্র কণার সাথে লেগে থেকে বাতাসে ভাসতে পারে।
তারা বলেন, আমাদের পরামর্শ হবে, বাস যাত্রার পুরোটা সময় মুখে মাস্ক পরে থাকতে হবে।
গবেষণার প্রধান লেখক হু শিজিয়ঙ (তিনি হুনান প্রভিন্সিয়াল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের হয়ে কাজ করেন) বলেন, নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, রোগী ‘ক’ চার ঘণ্টার বাস যাত্রার সময় একবারও অন্য কারো সাথে কথা বলেননি।
তবে বাসটি পরের নগরীতে থামার আগেই ভাইরাসটি অন্য সাতজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কেবল ওই রোগীর তুলনামূলক খুব কাছে থাকা লোকই ছিলেন না, বরং তার থেকে ছয় সারি সামনে থাকা তথা প্রায় ৪.৫ মিটার দূরে থাকা লোকও আক্রান্ত হয়েছেন।
পরে পরীক্ষায় তাদের সবার পজেটিভ দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজনের মধ্যে আবার রোগটির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
এসব যাত্রী বাস থেকে নামার পর প্রায় ৩০ মিনিট পর আগের গ্রুপ যাত্রী বাসটিতে চড়েন। এক যাত্রী বাসের সামনে সারির বিপরীত দিকে বসেছিলেন। তিনিও আক্রান্ত হন।
হু বলেন, এই রোগী মাস্ক পরেননি। তিনি সম্ভবত অ্যারোসল বা ক্ষুদ্র কণা শ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করিয়েছিলেন। আগের যাত্রীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি সেখানে গিয়েছিল।
অ্যারোসল হলো খুবই হালকা কণা। এটি দেহের দেহের তরলের অতি ক্ষুদ্র কণা তৈরী করে।
পত্রিকাটিতে বলা হয়, সম্ভাব্য কারণ হলো এই যে পুরোপুরি আবদ্ধ স্থানে বাতাসের প্রবাহ প্রধানত তাড়িত হয় এয়ার কন্ডিশনারের সৃষ্ট উত্তপ্ত বাতাস থেকে। উষ্ণ বাতাসের বৃদ্ধিতে ভাইরাসটির বাহক কণাগুলো আরো বেশি দূরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ওই বাস থেকে নেমে ‘ক’ হিসেবে পরিচিত যাত্রটি একটি মিনিবাসে চড়ে আরো প্রায় এক ঘণ্টা ভ্রমণ করেন। ভাইরাসটি এ সময় আরো দুই যাত্রীর দেহে প্রবেশ করে। তাদের একজন ‘ক’ রোগীর কাছ থেকে ৪.৫ মিটার দূরে বসেছিলেন।
মবে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে সমীক্ষাটি যখন সমাপ্ত হয়, তত দিনে রোগী ‘ক’ অন্তত ১৩ জনকে আক্রান্ত করে ফেলেছেন।
সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে কোভিড-১৯-এর বায়ুবাহিত স্থানান্তর সীমিত, কারণ রোগীদের মধ্য থেকে সৃষ্ট এর অতি ক্ষুদ্র কণা দ্রুত মাটিতে মিশে যায়।
চীনা ধারণার কারণেই চীনা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ লোকজনকে জনসাধারণ থেকে এক মিটার দূরে থাকতে বলেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টর ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ছয় ফুট (প্রায় ১.৮ মিটার) নিরাপদ দূরত্বে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, এই দুই বাসে যেসব যাত্রী মাস্ক পরেছেন, তাদের কেউ আক্রান্ত হননি।
তারা বলেন, এতে প্রমাণ হয় যে পাবলিক প্লেসে লোকজনের উচিত হবে মাস্ক পরা।
তারা বলেন, সাবওয়ে, গাড়ি, বিমান ইত্যাদিতে চড়লে পুরো সময় মাস্ক পরে থাকা উচিত এবং একইসাথে আপনার হাত যাতে কোনো স্থান স্পর্শ না করে সে দিকে নজর রাখতে হবে এবং আপনার মুখ স্পর্শ করার আগে হাত দুটি পরিষ্কার করতে হবে।
গবেষকেরা আরো বলেছেন, গণপরিবহনে স্যানিটেশন বাড়াতে হবে, এয়ার কন্ডিশনে যাতে আরো বেশি টাটকা বাতাস সরবরাহ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
তারা আরো বলেন, এসব যানবাহনের অভ্যন্তরভাগ এবং বিশেষ করে যাত্রীরা যে টার্মিটনালে নামে, দিনে একবার বা দুবার পরিষ্কার ও সংক্রমণমুক্ত রাখতে হবে।
বেইজিংয়ের একজন চিকিৎসক অবশ্য বলেন, এই সমীক্ষায় বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। কোভিড-১৯ রোগীদের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় জড়িত এই চিকিৎসক বলেন, সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ‘ক’ রোগীর একেবারে কাছে বসা যাত্রীরা আক্রান্ত হননি, যদিও তাদেরই রোগটি বহনকারী অ্যারোসল সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করার কথা।
তিনি বলেন, এই ভাইরাসটি স্থানান্তরিত হওয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনো সীমিত।