একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় এমপি প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে আওয়ামী লীগে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করা তথ্য ও জরিপ রিপোর্ট শেষবারের মতো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এরপর চূড়ান্ত তালিকা করা হবে। চূড়ান্ত ওই তালিকা আগামী সপ্তাহে প্রকাশ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করতে হিমশিম খাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তিগত মাধ্যমসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে আসা জরিপ রিপোর্টের ভিত্তিতে তৈরি তিনটি তালিকা এখন প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে। এই তালিকায় সংযোজিত প্রতিবেদনে তৃণমূলপর্যায়ে বর্তমান এমপিদের মধ্যে বেশির ভাগের অবস্থা নড়বড়ে। আগামী নির্বাচনে বিএনপির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অবস্থা অনেক এমপির নেই। এ অবস্থায় আজ আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলীয় এমপি প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- মনোনয়ন ব্যক্তিগত ব্যাপার, যে কেউ চাইতে পারে। কাকে দেয়া হবে তা জানেন দলের সভাপতি। পুনঃতফসিলের কারণে তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। কেউ আসলে তার মনোনয়ন ফরম জমা নেয়া হবে। দলের মনোনয়ন তালিকা চূড়ান্ত হতে চার-পাঁচ দিন সময় লাগবে। এখন প্রার্থীদের সার্ভে রিপোর্ট পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা জানান, আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হবে- এটা মাথায় রেখেই ক্লিন ইমেজসম্পন্ন প্রার্থী দেখে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কারো কোনো সুপারিশ বা তদবির কাজে আসবে না। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সোর্সের মাধ্যমে সংগ্রহ করা তথ্য এবং তৃণমূলে প্রার্থীর অবস্থান দেখে তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে চায় যারা নিজেদের কারিশমায় জিতে আসার মতো সক্ষমতা রাখেন। এক কথায় উইনেবল প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে দলীয় প্রধানের নির্দেশনা আছে। যেহেতু আগামী নির্বাচন অতীতের তুলনায় আওয়ামী লীগের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন জরিপ, দীর্ঘ দিন ধরে প্রকাশিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ এবং দলীয়ভাবে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বর্তমান এমপিদের অবস্থা খুবই নড়বড়ে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই আগামী নির্বাচনে জিতে আসার মতো অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি।
এবার বরগুনা-১ আসনে মনোনয়ন প্রার্থী সংখ্যায় রেকর্ড হয়েছে। এ আসনে সর্বোচ্চ ৫২ জন প্রার্থী দলের মনোনয়ন চেয়েছেন। মূলত, বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্রনাথ দেব শম্ভুকে পরিবর্তনের জন্যই তাদের মনোনয়ন চাওয়া। এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে শম্ভুর বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ করেন স্থানীয় নেতারা। বরগুনা-২ আসনেও মনোনয়ন চেয়েছেন ৩২ প্রার্থী।
ঢাকা-৫ আসন। এখানে আওয়ামী লীগ কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই আসনের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লা। এমপি বলয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার ছেলে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লা সজল। ওই আসনে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্তত ১০ জন।
এরা প্রত্যেকেই দীর্ঘ দিন ধরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভক্ত হয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওই আসনে জাসদের প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন।
নেত্রকোনা-১ আসনে বর্তমান এমপি ছবি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, টিআর-কাবিখা লুটপাট, নিয়োগ বাণিজ্য এবং সর্বোপরি নিজ দলীয় নেতাকর্মী নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাট্টা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এ আসনের সাবেক এমপি ও আনন্দমোহন কলেজের সাবেক ভিপি মোশতাক আহমেদ রুহীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে দলের তৃণমূল। তাকে আবারো এমপি হিসেবে চান তারা।
ফেনী-২ আসনের বর্তমান এমপি নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। গত নির্বাচনে মনোনয়নপত্রে সাজার কথা গোপন করে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ওই মামলা এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন। দলের জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান একরাম হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ আসনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুদ্দীন নাসির, আজহারুল হক আরজু ছাড়াও সাবেক আলোচিত এমপি জয়নাল হাজারী এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী মনোনয়ন চান।
নড়াইল-১ আসনের বর্তমান এমপি কবিরুল হক মুক্তি। তার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। টিআর, কাবিখার দুর্নীতি, স্কুল-কলেজে নিয়োগবাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে এমপির বিরুদ্ধে তৃণমূল নেতাকর্মীরা একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন এবং দলীয় প্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন বর্তমান এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওবায়দুল্লাহ আনোয়ার বুলবুল। দু’জনই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে লবিং করছেন। এ আসনের সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনের একটি গ্রুপও সক্রিয় রয়েছে। তিনটি গ্রুপই পরস্পরবিরোধী রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।
লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের বর্তমান এমপি আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে একাট্টা স্থানীয় আওয়ামী লীগ। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। সেখানে মনোনয়ন চান সাবেক এমপি ফরিদুন্নাহার লাইলী, আব্দুজ্জাহার সাজু, ড. শামসুল কবিরসহ আরো অনেকে।
ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ ও মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন এমপির বিরোধ কারোই অজানা নয়। দলীয় মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্রভাবে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরই তাদের বিরোধ আরো প্রকাশ্যে রূপ নেয়।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ১৭ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের ৩৪টি কমিটি রয়েছে। অর্থাৎ, প্রত্যেক ইউনিয়নে দু’টি কমিটি কার্যকর। একটি কমিটি জেলা অনুমোদিত, আর অপরটি স্থানীয় এমপির পকেট কমিটি বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতাকর্মীদের।
নাটোর-৪ আসনেও আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত। গত ১৫ অক্টোবর নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুসকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বয়কট করার ঘোষণ দেয়। গত বছরের জুলাই মাসে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সাতক্ষীরা-৩ আসনের এমপি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা: আ ফ ম রুহুল হককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ। গত ৯ জুলাই যশোরের মনিরামপুরে ছাত্রলীগ নেতারা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যশোর-২ আসনের এমপি মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনেন।
এ রকম বেশ কিছু এমপির বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের। অনেক এমপির হাত ধরে আওয়ামী লীগে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের লোকদের অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে বিভিন্ন সংস্থার জরিপে তথ্য উঠে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। দলের মধ্যকার বিরোধের রাজনীতি তুলে ধরে সম্প্রতি গণভবনে অনুষ্ঠিত বিশেষ বর্ধিত সভায় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেন, তৃণমূলে দলের নেতারা একমঞ্চে ওঠেন না, কেউ কারও চেহারাও দেখতে চান না। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয়া হয়। আওয়ামী লীগকে হারানোর জন্য আওয়ামী লীগই যথেষ্ট।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে প্রতি ছয় মাস পরপর জরিপ করেছেন আওয়ামী লীগ প্রধান। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, দলীয় জরিপ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং ব্যক্তিগত সোর্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কয়েক দফা তথ্য সংগ্রহ করে একাধিক তালিকা তৈরি করেছেন। সম্প্রতি তৃণমূল নেতাদের নিয়ে গণভবনে বর্ধিত সভার মাধ্যমে এবং তৃণমূল নেতাদের দেয়া চিঠির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপিদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কোন আসনে কতজন প্রার্থী আছে, নতুন কতজন প্রার্থী, কোন আসনে কোন প্রার্থীর অবস্থা কেমন- এসব বিষয়ে তীক্ষè নজর রয়েছে দলীয় প্রধানের। এ ছাড়াও বর্তমান এমপিদের মধ্যে তৃণমূলে কার অবস্থান পোক্ত, কার অবস্থান নড়বড়ে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ প্রধানের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। সব জরিপের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে ৩০০ আসনে কতজন প্রার্থী আছেন তার একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান এমপিদের মধ্যে ইমেজ সম্পন্ন এবং বিতর্কিতদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, বিতর্কিত আসনে কোনো প্রার্থীর অবস্থান সবচেয়ে শক্তিশালী ও জনপ্রিয়- এমন প্রার্থীদের নাম তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। তবে বিভিন্ন সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে বিএনপির প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অবস্থান অনেক এমপি ধরে রাখতে পারেননি। ওই সব আসনে বিকল্প প্রার্থী দিতেও কসরত করতে হচ্ছে দলটিকে। এসব কিছু পর্যালোচনা করেই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, এবার বাছাইটা অনেক নিপুণ হবে। যতদূর জানি, বিভিন্ন সোর্স থেকে বর্তমান এমপিদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তথ্য সংগ্রহ করেছেন। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। রাজনৈতিক পরিচয় ঠিক রেখে এলাকায় অধিক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে।
দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য লে. কর্নেল (অব:) ফারুক খান বলেন, প্রত্যেকটি আসনে আওয়ামী লীগের ১০ থেকে ১৫ জন যোগ্যপ্রার্থী রয়েছেন। তারা সবাই মনোনয়ন পাওয়ার দাবি রাখেন। যেসব এমপি বা নেতার কারণে দলের ইমেজ ক্ষুণœ হয়েছে তারা এবার মনোনয়ন পাবেন না। আর শেষ পর্যন্ত দল যাকেই মনোনয়ন দেবে সবাই তার পক্ষেই কাজ করবেন বলে আমরা আশাবাদী।