দেশে চলমান রাজনীতি ধীরে ধীরে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল। পাইকারিভাবে সংলাপ করে বিষয়টাকে মামুলিভাবে দেখানোর প্রয়াস চললেও সংলাপে মূল ধারা যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ফলে রাজনীতির দেন-দরবার চলছে মূলত তাদেরকে কেন্দ্র করে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে দ্বিতীয় দফা সংলাপে ফ্রন্ট তিনটি বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহা চাইবে। অন্য দিকে ক্ষমতাসীন পক্ষ অনড় থাকবে দু’টি বিষয়ে। ফলে এখন রাজনীতি কেন্দ্রীভূত হয়েছে সব ছাড়িয়ে পাঁচটি ইস্যুতে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যফ্রন্টের দ্বিতীয় দফা সংলাপ হবে আগামীকাল বুধবার। ছোট পরিসরের এই সংলাপে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সংবিধানের ভেতর থেকেই দুইটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবে ঐক্যফ্রন্ট। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আইনি প্রক্রিয়ায় কিভাবে সম্ভব সেটিও সুনির্দিষ্ট করে জানানো হবে। ঐক্যফ্রন্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্রে বলা হয়, সংলাপের দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ ভেঙে নির্বাচন এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি এই তিন বিষয়ে ফয়সালার চূড়ান্ত চেষ্টা চালানো হবে।
এ দিকে আজ মঙ্গলবার রাজধানীতে বড় সমাবেশ করবে ঐক্যফ্রন্ট। গুরুত্বপূর্ণ এই জনসভা থেকে দুই ধরনের বার্তা দিতে চায় এই জোট। সংলাপ সফল হলে পুরোদমে নির্বাচনী মাঠে নামা আর ব্যর্থ হলে দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামতে কর্মীদের দিকনির্দেশনামূলক কৌশলী বার্তা দিবেন ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। নতুন কর্মসূচিও দেয়া হতে পারে। তবে তা কঠোর নয়।
গতকাল সোমবার ২৪ শর্তে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার লিখিত অনুমতি পায় ঐক্যফ্রন্ট। বেলা ২টায় এ জনসভা শুরু হবে। ঐক্যফ্রন্ট মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে জনসভায় গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই জনসভায় বিপুল লোক সমাগমের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি বড় ধরনের শোডাউন করতে যাচ্ছে। এ জন্য প্রস্তুতিও শেষ করেছে।
ইতোমধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকেও নেতাকর্মীদের জনসভায় যোগ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জনসভার আগে গতকাল সোমবার জনসভাস্থল পরিদর্শন করেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান জানান, জনসভায় রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা যোগ দেবেন। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা হবে এটি।
ফ্রন্টের সিনিয়র এক নেতা জানান, দ্বিতীয় দফা সংলাপের মধ্য দিয়ে সমঝোতা হলে ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান হবে এক ধরনের; অর্থাৎ আন্দোলন বাদ দিয়ে তারা নির্বাচনের মাঠে নামবে। আর সংলাপ ব্যর্থ হলে আন্দোলনের পথেই হাঁটবে তারা। এই বার্তাটিই থাকবে জনসভায়।
কর্মসূচির বিষয়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য হালকা কর্মসূচি দেয়া হবে। কঠোর কর্মসূচি আসবে আরো পরে।
সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট যেসব প্রস্তাব দেয়ার চিন্তা করছে : ঐক্যফ্রন্ট সূত্রে জানা গেছে, দ্বিতীয় দফা সংলাপে শীর্ষ নেতারা ফ্রন্টের দাবি-দাওয়ার মধ্য থেকে তিনটি দফার বিষয়ে চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করবেন। এগুলো হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন এবং বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। নির্বাচনকালীন সরকার ও সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি পূরণ সংবিধানের ভেতর থেকেই সম্ভব বলে মনে করছেন নেতারা। গত কয়েক দিনের সিরিজ বৈঠকে সংবিধান থেকেই এর সমাধান খুঁজে বের করা হয়েছে।
জানা গেছে, সংবিধানের ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদে মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্যদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ প্রদান করবেন এমন প্রস্তাব তুলে ধরতে পারে ঐক্যফন্ট। সে ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে দেয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদ বলা আছে, এক-দশমাংশ মন্ত্রী অনির্বাচিতদের মধ্য থেকে মনোনীত হতে পারবেন। সংবিধানের এই বিধান অনুযায়ীÑ ঐক্যফ্রন্ট সংসদ ভেঙে দেয়ার পর যে মন্ত্রিসভা অন্তর্বর্তী দায়িত্ব পালন করবে, সেখানে বিরোধী জোট থেকে সুনির্দিষ্টসংখ্যক সদস্য নেয়ার প্রস্তাব দেবে; যাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখা হবে। জানা গেছে, সব দলের সাথে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে সরকারি দল রাজি না হলে টেকনোক্র্যাট কোটায় তাদের অংশীদারিত্ব রাখার এই প্রস্তাব দেয়া হবে।
খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় সম্ভব বলে মনে করছেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। সংলাপে তাদের প্রস্তাব থাকবে সরকার খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করবে না অথবা তার সাজা স্থগিত করবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সংলাপে আলোচনা হতে পারে বলে এরই মধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সরকারি দল খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার পক্ষপাতী বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে।
এ দিকে গত রাতেও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের মতিঝিলের চেম্বারে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বৈঠক করেছেন। জানা গেছে, বৈঠকে সংবিধান ও আইনের ভিত্তিতে সাত দফার বিভিন্ন দাবিগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হয়। আজকের সমাবেশে কী ধরনের কর্মসূচি দেয়া হবে, তা নিয়েও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নেতারা।
এ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে সংলাপকে গুরুত্ব দিয়েই দেখছে আওয়ামী লীগ। ঐক্যফ্রন্টের দাবি-দাওয়া নিয়ে দল ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে বিশ্লেষণ অব্যাহত রয়েছে। তবে আগামীকাল বুধবার দ্বিতীয় দফা সংলাপ সামনে রেখে দুই ইস্যুতে অনড় অবস্থানে থাকবে আওয়ামী লীগ। প্রথমত, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি অর্থাৎ তাকে মুক্তি দেয়া হবে না এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা বহাল থাকা অর্থাৎ তিনি পদত্যাগ করবেন না। এই দুই বিষয়ে ঐকমত্য হলে আগামী নির্বাচনকালীন সরকারে ঐক্যফ্রন্টের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার সাথে সরকার জড়িত নয়। যে মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে অবস্থান করছেন ওই মামলাটি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হয়েছিল। দীর্ঘ শুনানির পরে আদালত রায় দিয়েছেন। ফলে বিএনপি নেত্রীর মুক্তির বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। আর নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান থাকবেন বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। এটি সংবিধানেরই অংশ। আওয়ামী লীগ সব সময় সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে চায়। ফলে সংবিধানের মধ্যে থেকে ঐক্যফ্রন্ট সংলাপে দাবি উত্থাপন করলে সরকার সেটা ভেবে দেখবে।
গত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের আহ্বান এবং নির্বাচনকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেয়ার উদাহরণ টেনে শীর্ষ এক নেতা বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে সংলাপের জন্য টেলিফোন করেছিলেন। কোন কোন মন্ত্রণালয় বিএনপি চায় সেটাও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি তথা খালেদা জিয়া সেটা মেনে না নিয়ে আন্দোলন করলেন। এই সংলাপ আয়োজনের বিষয়ে জোট-মহাজোটের মধ্যে মত-দ্বিমত রয়েছে। জোটের কোনো কোনো দল ঐক্যফ্রন্টের সাথে সংলাপ না করার কথাও বলেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর উদার মন-মানসিকতার কারণেই সংলাপ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী চান আগামীতে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। ওই নির্বাচনে জনগণ যাকে ভোট দেবে তারাই ক্ষমতায় যাবে।
অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগ বা সরকারের তরফ থেকে কোনো কিছুই আগবাড়িয়ে বলা হবে না। ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের পক্ষ থেকে যদি কোনো দাবি উত্থাপন করা হয় তাহলে আলোচনার টেবিলেই সিদ্ধান্ত হবে। ঐক্যফ্রন্ট জোরালোভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইলে প্রধানমন্ত্রী সেটি ইতিবাচক হিসেবে দেখবেন।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন সরকারপ্রধান। তবে সেটি নির্ভর করছে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের জোরালো দাবির ওপর। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবি জানালে কোনোভাবেই সংবিধানের বাইরে যাবে না আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান মেনে নিলেই কেবল আলোচনায় এগোতে চায় ক্ষমতাসীনরা। এই একটা বিষয়ে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না আওয়ামী লীগ। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নিলেই কেবল আগামী নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারে থাকার সুযোগ পেতে পারে ঐক্যফ্রন্ট। সেটিও সাংবিধানিক রূপরেখার মধ্যে থেকে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঐক্যফ্রন্ট এবং যুক্তফ্রন্টের সাথে সংলাপে তাদের বেশ কিছু দাবি ইতোমধ্যে সরকার মেনে নিয়েছে। আগামী সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংবিধান অনুযায়ী যৌক্তিক যেসব দাবি জানাবে তা ভেবে দেখা হবে।
সংবিধান অনুযায়ী যদি সংসদ ভেঙে দেয়ার প্রস্তাব তারা করে সেটা নিয়েও আলোচনা হবে। এতে সরকার কোনো চাপ অনুভব করছে না। সংবিধানসিদ্ধ কোনো দাবি থাকলে সেগুলো মেনে নেয়া হবে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি তো এ বিষয়ে কিছু বলেনি। প্যারোলে মুক্তি যদি ঐক্যফ্রন্ট চায় তাহলে আলোচনার পথ খোলা আছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা হতেই পারে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, আগামী নির্বাচন কিভাবে অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ করা যায়, সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া যায় সে বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট নতুন কোনো দাবি-দাওয়া করলে আলোচনা হবে। তবে সেটি সংবিধান সম্মত হতে হবে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে কোনো দাবি করলে প্রধানমন্ত্রী সেটা মানবেন বলে আমার মনে হয় না।