আমি কি তোমার অন্তর প্রশস্ত-প্রশান্ত করে দেইনি?
ধরুন, আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনি কাজের পাশাপাশি সন্ধ্যায় ইউনিভারসিটি গিয়ে পার্টটাইম মাস্টার্স বা পিএইচডি করবেন। আপনার পরিবার আপনার এই সিদ্ধান্ত শুনে বড়ই খুশি হবে। বংশে একজন মাস্টার্স/পিএইচডি করা ছেলে/মেয়ে থাকবে, কী সৌভাগ্যের ব্যাপার! ক্লাসে যাওয়ার আগে আপনার জন্য নাস্তা টেবিলে রাখা থাকবে। ক্লাস করে এসে আপনি যেন শান্তিতে ঘুমোতে পারেন, সেজন্য বাচ্চাদেরকে আগেই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে। মেহমানরা বেড়াতে এসে যেন আপনার পড়াশুনায় ক্ষতি না করে, সেজন্য চৌদ্দগুষ্টিতে সাবধান নোটিস চলে যাবে। কেউ যদি এসেও পড়ে, আপনি দেখা করতে না আসলে কোনো সমস্যা নেই, কারণ আপনার পরীক্ষা চলছে। আপনার পরীক্ষার সময় বাড়িতে কারফিউ পড়ে যাবে। কেউ জোরে টিভি ছাড়বে না, ফোনে গল্প করবে না। কিছুক্ষণ পরপর চা, নাস্তা আসতে থাকবে। আপনাকে যথাসাধ্য সবরকম শান্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। একসময় আপনি মাস্টার্স/পিএইচডি শেষ করবেন। আপনার স্বামী-স্ত্রী-বাবা-মা গর্ব করে সবার কাছে আপনার অর্জনের কথা বলবে।
কিন্তু ধরুন, আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কাজের পাশাপাশি একটা ইসলামিক ডিগ্রির জন্য পড়াশুনা করবেন, বা এলাকার মুসলিম ভাইবোনদের সাথে নিয়মিত ইসলামি আলোচনায় অংশ নেবেন, বা কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যোগ দেবেন। আপনার পরিবারের সদস্যরা এই কথা শোনার পর আপনার উপর শুরু হবে তাদের যাবতীয় দাবি এবং অভিযোগের বৃষ্টি। এমনিতেই কাজের বাইরে আপনাকে কম পাওয়া যায়, এখন কেন আরও কম পাওয়া যাবে? যেই কাজ করতে আপনি বাধ্য নন, কেন আপনি সেই কাজের পিছনে এত সময় দেবেন? এগুলো না করে শুধু নামাজ-রোজা করলে ক্ষতি কী হবে? আমরা কী মুসলিম না? এগুলো না করলে কি জান্নাতে যাওয়া যায় না?
—এরকম হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে আপনি কোনোমতে সবাইকে দিনের পর দিন ম্যানেজ করে, নিয়মিত তাদের কটু কথা শুনে হয়তো সপ্তাহে একদিন, দু’দিন করে ইসলামের জন্য পড়াশুনা করবেন। কোনো ইসলামি আলোচনা, সেচ্ছাসেবী কাজে মাসে এক-দুইবার অংশ নেবেন। কিন্তু আপনার এই কাজে সাহায্য করার জন্য কেউ টিভি দেখা কমিয়ে দেবে না, ফোনে গল্প করা বন্ধ করবে না, আপনার পড়ার সময় বাচ্চাগুলোকে অন্য ঘরে খেলতে নিয়ে যাবে না। নিজে উঠে চা, নাস্তা বানিয়ে খেতে হবে। আপনার পরীক্ষাই চলুক, কোনো জরুরি প্রোগ্রামই থাকুক, বা রংপুরে কম্বল বিতরণের দায়িত্বই থাকুক না কেন। বাসায় কোনো মুরব্বি আত্মীয় আসলে, শ্বশুর-শাশুড়ি আসলে, বাচ্চাদের পরীক্ষা চললে কেউ আপনাকে একটুও ছাড় দেবে না। আপনাকে তখন সব বাদ দিয়ে সামাজিকতা করতে হবে।
বরং যখন আপনার পড়াশুনার বেশি চাপ যাবে, বা ইসলামি কাজে একটু বেশি সময় দিতে হবে, তখনি আপনার কাছের জনের মাথা বেশি গরম হয়ে যাবে। নিয়মিত ঝগড়া শুরু হবে। আত্মীয়স্বজন আপনাকে ফোন করে আবার ‘সাধারণ মুসলিম’ হয়ে যাওয়ার জন্য বারবার বোঝাবে। কবে কোন মুসলিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, জেলে নিয়ে কীভাবে পায়ের নখ তুলে নির্যাতন করেছিল, কোন ইসলামি দল কবে কোন নিরীহ মুসলিমকে ঘোল খাইয়েছিল —এই সব বলে আপনাকে নিয়মিত ভয় দেখাবে।
এইসব হাজারো ঝড়-ঝাপটা, প্রতিকূলতার মধ্যেও দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধরে প্রতিদিন হাসিমুখে চেষ্টা করে যাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। এত যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য প্রশস্ত অন্তর দরকার। অন্তরের প্রশস্ততা না থাকলে, অল্পতেই মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখায়। মানুষের সাথে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। দিনের পর দিন এত অন্যায়, অবিচার সহ্য করতে না পেরে বুক ভেঙ্গে যায়। তারপর একসময় ইসলামের পথ থেকে তারা ঝরে যায়। একারণে যাদের অন্তরকে আল্লাহ تعالى প্রশস্ত করে দেন, শুধু তারাই পারে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামের পথে অবিচল থাকতে।
কাজেই যাকে আল্লাহ সঠিক পথ দেখানোর ইচ্ছা করেন, তার অন্তরকে তিনি ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। [আল-আন‘আম ১২৫]
একইসাথে অন্তরের প্রশস্ততা না থাকলে ইসলামের নিয়মকানুন মেনে চলা সবসময় সম্ভব হয় না। তখন মানুষ ইসলাম নিয়ে নানা ধরণের সন্দেহে ভোগে—
“সুদ আর ব্যবসায় লাভ তো একই কথা। কেন ইসলামে সুদ হারাম?”
“দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে কেন? তিন ওয়াক্ত হলে কী সমস্যা হতো?”
“মাত্র আড়াই ভাগ সম্পদ যাকাত দিয়ে কার কী লাভ হবে?”
“কেন ছেলেদেরকে মেয়েদের দ্বিগুণ সম্পত্তি দেওয়া হয়? এটা কি অন্যায় নয়?”
“কেন মেয়েদেরকে হিজাবের মতো একটা কঠিন কাজ করতে দেওয়া হলো? ছেলেদের কেন হিজাবের কষ্ট করতে হয় না?”
“মেয়েদেরকে কেন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার কষ্ট করতে হবে? ছেলেরা বাচ্চা জন্ম দেয় না কেন?”
—এরকম নানা সমস্যায় মানুষ ভোগে। ইসলাম তার কাছে একটা তিতা ওষুধ হয়ে যায়। চোখ-মুখ কুঁচকে সে কোনোভাবে ইসলাম মেনে চলে। কিন্তু সেই মানায় কোনো শান্তি, তৃপ্তি, কৃতজ্ঞতা থাকে না।
কিন্তু যখন অন্তরের প্রশস্ততা চলে আসে, তখন আল্লাহর تعالى নির্দেশ মানতে আর কোনো সমস্যা থাকে। মানুষ বুঝে যায় যে, সে ছয়শ কোটি মানুষের মধ্যে এক মামুলি মানুষ মাত্র। তার পক্ষে পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতিসহ পুরো মানবজাতির জন্য কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, তা বোঝা সম্ভব নয়। তার যতগুলো পিএইচডি ডিগ্রিই থাকুক না কেন। সে যত দেশই ঘুরে দেখুক না কেন। তার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া সমাধান পুরো মানবজাতির জন্য সবসময় কল্যাণ বয়ে আনার সম্ভাবনা খুবই কম। মানুষ যখন নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারে, নিজের অহংকারকে দমাতে পারে, তখন সে আল্লাহর تعالى প্রতি পরম ভরসায় তাঁর تعالى সব নির্দেশ খুশি মনে মেনে চলে। ইসলাম মেনে তখন সে শান্তি এবং তৃপ্তি খুঁজে পায়। আল্লাহ تعالى তাকে ইসলাম বোঝার সামর্থ্য দিয়েছেন, এজন্য সে কৃতজ্ঞতায় বিনত হয়। তখন তার প্রতিটি সিজদা হয়ে যায় কৃতজ্ঞতায় ভরা, বিনম্র, শ্রদ্ধার সিজদা।
যার অন্তরকে আল্লাহ প্রশস্ত করে দেন ইসলামের প্রতি এবং যে তার রবের পক্ষ থেকে আসা এক আলোর মধ্যে রয়েছে, সে কি আর তার মতো হবে, যে কিনা এগুলো পায়নি? … [আয-যুমার ২২]
মুসা عليه السلام এর সেই বিখ্যাত দুআ আমরা নিয়মিত করি—
ও আমার প্রভু, আমার অন্তরকে প্রশস্ত-প্রশান্ত করে দিন। আমার কাজগুলো সহজ করে দিন। … [ত্বহা ২৫-২৬]
তাহলে অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। অবশ্যই কষ্টের সাথেই রয়েছে স্বস্তি
আপনার বাবা প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হঠাৎ বিছানায় পড়ে গেলেন? দেখবেন, আপনার ভাই নিজেই মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে ভালো ফল করছে। একইসাথে আপনার মা হিন্দি সিরিয়াল দেখা বাদ দিয়ে স্বামীর সেবা করছে।
আপনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে চাকরি হারিয়ে ফেললেন? দেখবেন, আপনার তরুণ ছেলেটা আরও বেশি সময় ঘরে থেকে বখাটে ছেলেদের সাথে মেশা কমিয়ে দিয়েছে। নিজেই চাকরির খোঁজ করছে। একইসাথে আপনার স্ত্রী হঠাৎ করে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেছে।
—এই আয়াতে আল্লাহ تعالى গ্যারান্টি দিয়েছেন যে, প্রতিটি কষ্টের সাথে জীবনের অন্য কোনো না কোনো দিকে কমপক্ষে দুটো স্বস্তি আসবেই। দেখবেন জীবনে একটা কষ্ট এসেছে, কিন্তু অন্য দুটো দিকে ভালো কিছু না কিছু হয়েছে।[৪] যাদের আল্লাহর تعالى উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং আস্থা আছে, তারা বিপদের মধ্যে ডুবে থেকেও দেখতে পান যে, আল্লাহ تعالى তাকে কতভাবে সাহায্য করছেন সেই বিপদ পার করার জন্য। কিন্তু যাদের ঈমান নড়বড়ে, আল্লাহর تعالى উপর আস্থা নেই, তারা বিপদে পড়ে চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকেন।
অনেক সময় আমরা বিপদে পড়ে আল্লাহর تعالى উপর ভরসা হারিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকি। যতটা না কষ্ট এসেছে, তার থেকে বেশি কষ্ট, অশান্তি নিজেই সৃষ্টি করে নিই। শরীরের দাবির দিকে খেয়াল না রেখে অসুস্থ হয়ে যাই। তারপর চরম অবসাদ, হতাশায় ডুবে যাই। এগুলো সবই আমাদের নিজেদের তৈরি সমস্যা। আসল সমস্যা দেখা যায় বড় কোনো সমস্যাই ছিল না। কিন্তু আমাদের অস্থিরতা, অকৃতজ্ঞতা এবং ভুলের কারণে সেই সমস্যা ডালপালা গজিয়ে বিশাল জটিল আকার ধারণ করে।
আমাদের জীবনটা যে কষ্ট এবং স্বস্তির একটি চক্র, সেটাও এই আয়াত দুটিতে দেখানো হয়েছে। কোনো কষ্ট থেকে স্বস্তি পেলে আমরা যেন মনে না করি যে, এখন থেকে শুধু আরামেই থাকবো।[৭] —“এত বড় একটা কষ্ট পার করলাম, আর কোনো কষ্ট নিশ্চয়ই আল্লাহ تعالى আমাকে দেবেন না? আমি না একজন সাচ্চা মুসলিম? মুসলিমদের তো বার বার বিপদ হওয়ার কথা না?” —তারপর যখন আবার জীবনে কোনো কষ্ট আসে, তখন হতাশায় ডুবে যাই — “কেন? আমার জীবনে বার বার কষ্ট আসে কেন? আমি কী অন্যায় করেছি? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, যাকাত দেই। তাহলে আমার জীবনে বার বার কষ্ট আসে কেন?”
আমরা যদি তিন ধরণের মানুষকে দেখি— ১) নিয়মিত মুসলিম কিন্তু ঈমানে ফাটল আছে, ২) নামে মুসলিম, কাজে যে কী সে নিজেও জানে না, ৩) বাইরে মুসলিম, ভেতরে ইসলাম বিদ্বেষী — এদেরকে আলাদা করার জন্য আল্লাহ تعالى নানা ধরণের পরীক্ষা দেন। সেই পরীক্ষাগুলো অনেক সময় ভীষণ কষ্টের হয়। কিন্তু এই পরীক্ষাগুলোর মধ্য দিয়েই তাদের ঈমানের যাচাই হয়ে যায়। তাদের ভেতরে আসলে কী আছে, তা বেরিয়ে আসে।[৭]
কু’রআনে শুধু এই একটি আয়াত নয়, এরকম আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা আমাদেরকে হতাশা, অবসাদ, অস্থিরতা, অপ্রাপ্তির কষ্ট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। জীবনে কেন কোনো একটি কষ্ট এসেছে, তা বুঝতে সাহায্য করবে। কুর‘আন আমাদের আত্মার জন্য এক নিরাময়। একে আল্লাহ تعالى পাঠিয়েছেন যেন দিশেহারা মানবজাতি পথ খুঁজে পায়। একারণে কুর‘আনে আমরা অনেক আয়াত পাই, যেখানে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জীবনের নানা সমস্যা মোকাবেলা করার পথ দেখিয়ে দিয়েছেন—
চারিদিকে এত কষ্ট, এত কান্না — ভাবছেন আপনার কী দোষ?
তিনিই সেই সত্তা, যিনি মানুষকে হাসান এবং কাঁদান। তিনিই তো মৃত্যু দেন, জীবন দেন। [আন-নাজম ৫৩:৪৩]
তারা কি লক্ষ্য করে দেখে না যে, প্রতি বছর তাদের উপর দুই-একবার বিপদ আসছে? এরপরও ওরা তওবাহ করে না, উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না। [আত-তাওবাহ ৯:১২৬]
জীবনটা অতিরিক্ত কষ্টের মনে হচ্ছে? আর পারছেন না সহ্য করতে?
আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা কখনো দেন না। প্রত্যেকেই যা ভালো করেছে তার পুরস্কার পায়, যা খারাপ করেছে তার পরিণাম ভোগ করে। [আল-বাক্বারাহ ২:২৮৬]
জীবনটা শুধুই কষ্ট, আর কষ্ট? কোনো ভালো কিছু নেই?
প্রতিটি কষ্টের সাথে অবশ্যই অন্য কোনো না কোনো দিক থেকে স্বস্তি রয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, অবশ্যই প্রতিটি কষ্টের সাথে অন্য দিকে স্বস্তি আছেই। [আল-ইনশিরাহ ৯৪:৫-৬]
আপনি নামাজ, রোজা, যাকাত সব নিয়ম মেনে চলেন। তারপরেও আপনার জীবনে কেন এত কষ্ট?
মানুষ কি ভেবেছে যে, তাদেরকে কোনো পরীক্ষা না করেই ছেড়ে দেওয়া হবে, কারণ তারা মুখে বলছে, “আমরা তো মুমিন!” [আল-আনকাবুত ২৯:২]
তোমরা কি ভেবেছিলে যে, তোমাদের মধ্যে থেকে কারা আল্লাহর পথে আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং কারা ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করে — সেটা আল্লাহ প্রকাশ না করে দেওয়ার আগেই তোমরা জান্নাত পেয়ে যাবে? [আলে-ইমরান ৩:১৪২]
যে-ই আমার পথনির্দেশ থেকে দূরে চলে যাবে, তার-ই জীবন হয়ে যাবে ভীষণ কষ্টের। [ত্বাহা ২০:১২৪]
অশান্তিতে ছটফট করছেন? রাতে ঘুমাতে পারছেন না? ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন? ওষুধ খেয়েও মনে শান্তি আসছে না?
যাদের ঈমান আছে, তারা যখন আল্লাহর কথা ভাবে, যিকির করে, তখন তাদের মন শান্তি খুঁজে পায়। মনে রেখ, আল্লাহর কথা ভাবলে, যিকির করলে, অবশ্যই মন শান্তি খুঁজে পাবেই। [আর-রাদ ১৩:২৮-২৯]
তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ, ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করো এবং নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও, কারণ আল্লাহ তাদের সাথে আছেন, যারা ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করে। [আল-বাক্বারাহ ২:১৫৩]
দেশে অরাজকতা, অশান্তি, অপরাধ দেখে সবসময় অকালে মৃত্যুর ভয়ে কাবু হয়ে আছেন? ভাবছেন বিদেশে চলে যাবেন?
তুমি যেখানেই যাও না কেন, মৃত্যু তোমাকে ধরবেই। তুমি যদি অনেক উঁচু দালান বানিয়েও থাকো। [আন-নিসা ৪:৭৮]
বলো, “তোমরা যদি নিজেদের ঘরের ভিতরেও থাকতে, যারা খুন হবে বলে নির্ধারণ করা হয়েছিল, তারা নিজেরাই বের হয়ে নিজেদের মৃত্যুর সাথে দেখা করতে যেত।” [আলে-ইমরান ৩:১৫৪]
আপনার কোনো নিকটজন অকালে প্রাণ হারালেন আর আপনি ভাবছেন— হায়, যদি সে অমুক করত, অমুক না করত, তাহলে সে বেঁচে যেত?
তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ বলে দাবি করো, ওই সব কাফিরদের মতো হয়ো না, যারা তাদের ভাইদের সম্পর্কে বলে (যখন তারা `ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, ভ্রমণে গিয়েছিল) “হায়রে, যদি তারা আমাদের সাথে থাকতো, তাহলে তারা মারা যেত না, খুনও হতো না।” আল্লাহ এই ধরনের চিন্তাভাবনাকে তাদের অন্তরে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার উৎস করে দেন। শুধুমাত্র আল্লাহই প্রাণ দেন, মৃত্যু ঘটান। তোমরা কী করো, তার সব তিনি দেখছেন। [আলে-ইমরান ৩:১৫৬]
অমুকের এত বাড়ি-গাড়ি-টাকা দেখে ভাবছেন, কেন তার মতো এমন নামে-মুসলিম কাজে-কাফিরের জীবন এত আরামের?
ওদের এত ধনসম্পত্তি, সন্তানসন্ততি তোমাকে অবাক করতে দিয়ো না। এগুলো দিয়ে আল্লাহ শুধুমাত্র ওদেরকে এই দুনিয়াতে পরীক্ষা নিতে চান, যেন তাদের আত্মা কাফির অবস্থায় এখান থেকে চিরবিদায় নেয়। [আত-তাওবাহ ৯:৮৫]
চাকরি হারিয়ে আপনার মাথায় হাত: কেন আপনার সাথে এমনটা হলো? কেন আপনার সন্তান এত গুরুতর অসুস্থ হলো? কেন আপনার বাবা এই দুঃসময়ে মারা গেলেন?
আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা, সম্পত্তি, জীবন এবং ফসল হারানো দিয়ে পরীক্ষা করবই। জীবনে কোনো বিপদ আসলে যারা ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করে এবং বিপদে পড়লে সাথে সাথে বলে, “আমরা তো আল্লাহরই সম্পত্তি। আল্লাহরই কাছে আমরা শেষ পর্যন্ত ফিরে যাবো” — তাদেরকে সুসংবাদ দাও! ওদের উপর তাদের প্রভুর কাছ থেকে আছে বিশেষ অনুগ্রহ এবং শান্তি। এধরনের মানুষরাই সঠিক পথে আছে। [আল-বাক্বারাহ ২:১৫৫-১৫৭]
মনে রেখো, তোমার যা ধনসম্পদ আছে এবং তোমার সন্তানরা, এগুলো শুধুই তোমার জন্য পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। আর মনে রেখো, আল্লাহর কাছে রয়েছে অপরিসীম পুরস্কার। [আল-আনফাল ৮:২৮]
তারা কি লক্ষ্য করে দেখে না যে, প্রতিবছর তাদের উপর দুই-একবার বিপদ আসছে? এরপরও ওরা তওবাহ করে না, উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না। [আত-তাওবাহ ৯:১২৬]
—আসুন আমরা কু’রআনের আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করি। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কু’রআন দিয়েছেন এক আত্মিক নিরাময় হিসেবে। আমাদের অনেক মানসিক সমস্যার সমাধান রয়েছে কু’রআনে। নিয়মিত বুঝে কু’রআন পড়লে আমরা খুব সহজেই ওষুধের উপর আমাদের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারব, স্ট্রেস-ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত হয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারব — ইন শাআ আল্লাহ।
তাই যখনি কোনো কাজ থেকে অবসর পাও, তখনি নিবেদিত হও, তোমার প্রভুকে পাওয়ার জন্য তাঁর দিকে ফিরে যাও
এই শেষ আয়াতটি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম কোনো পার্টটাইম প্রজেক্ট না যে, বাকি সব কাজ শেষ হলে যদি সময় পাওয়া যায় তো একা কিছু ধর্ম-কর্ম করবো, না হলে কী আর করা? পড়ালেখা, চাকরি, পরিবারের দেখাশোনা, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া, আর্টিকেল লেখা, ফেইসবুকে ধর্মের কথা বলা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সমস্যার সমাধান করা— এত সব দায়িত্বের পর একা ধর্ম-কর্ম করার সময় কোথায়?
বরং আল্লাহ تعالى বলছেন যে, যখনি আমরা কাজের ফাঁকে সময় পাবো, তখনি যেন আমরা আল্লাহর تعالى প্রতি আরও নিবেদিত হই। শুধুই আল্লাহর تعالى প্রতি একান্ত ইবাদতে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলি। এই একান্ত আল্লাহর تعالى ইবাদত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই কথাটা কাকে বলা হয়েছে, তা আমরা লক্ষ্য করি। রাসুল عليه السلام ঘুমের থেকে ওঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টাই ব্যস্ত থাকতেন ইসলামের প্রচারে। তার প্রতিটা কাজই ছিল আল্লাহর تعالى ইবাদত। কিন্তু এরপরও আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে তাকে বলছেন যে, একজন রাসুল হিসেবে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করার পরেও অবসর পাওয়া মাত্রই একান্তভাবে ব্যক্তিগত ইবাদতে নিজেকে পরিশ্রান্ত করে ফেলতে হবে।
এথেকে সহজেই বোঝা যায় যে, আমাদের জীবনে ব্যক্তিগত ইবাদতে সময় দেওয়াটা কত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনকভাবে আজকে অনেক মুসলিমেরই ব্যক্তিগত ইবাদত হয়ে গেছে খুবই নিচু মানের। পরিবার, সন্তান, বন্ধুবান্ধব থেকে নিজেকে আলাদা করে, প্রভুর সাথে একান্ত ব্যক্তিগত সময় কাটানোর জন্য কোনো চেষ্টা নেই। বরং এসবের মধ্যেই ডুবে থেকে কোনোমতে নুন্যতম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজটা আদায় করতে পারলেই যেন পার পেয়ে যাই।
একটু ঘুম ত্যাগ করে, একটু কম টিভি দেখে, একটু কম ফেসবুক করে, সেই সময়টা একান্তভাবে আল্লাহর تعالى প্রতি নিজেকে নিবেদিত করে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এই একান্ত ব্যক্তিগত ইবাদতই পারে একজন বান্দাকে আল্লাহর تعالى আরও কাছে নিয়ে যেতে। তাঁর تعالى সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে। কিন্তু যারা নীরবে নিভৃতে ব্যক্তিগত ইবাদত করে না, তাদের সাথে আল্লাহর تعالى সম্পর্ক হয় এক ধরণের দায়সারা সম্পর্ক। ইসলাম মানতে হবে, তাই মানে। কিন্তু এভাবে মেনে তারা কোনো শান্তি, তৃপ্তি পায় না। হাজারো প্রশ্ন এবং অভিযোগ নিয়ে জীবনটা পার করে, একসময় অশান্ত, অতৃপ্ত আত্মা হয়ে আল্লাহর تعالى কাছে ফিরে যায়।