সভা-সমাবেশের অনুমতি ছাড়া সংলাপে বিশেষ কোনো সমাধান আসেনি বলে জানিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা সংলাপ শেষে রাতে বেইলি রোডে নিজের বাসায় এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা সংলাপ নিয়ে এমন মন্তব্য করেন। তবে এর আগে গণভবনে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন- ‘১৯৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বঙ্গবন্ধু সংসদের সমাপনী অধিবেশনে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, বিশ্বের বুকে তারা একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।’
সংলাপের সূচনা বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী- এই ঐতিহাসিক সন্ধ্যায় আপনাকে এবং আপনার দল ও জোটের সহকর্মীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। আপনাকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি দৃপ্ত অঙ্গিকার করার জন্য, যেখানে আপনি বলেছেন; অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য আপনার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত। আমরা বিশ্বাস করি, একথায় আমাদের মতো অনেকেই- বিশেষ করে দেশবাসী আশ্বস্ত এবং বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছেন। আপনি অবগত আছেন যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত মহান স্বাধীনতার প্রধান লক্ষ্য ছিল, সংবিধানের সাত অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘সংবিধানের প্রাধান্য’-কে সমুন্নত করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, সংবিধানের এই ঘোষণার সঙ্গে বাক্-ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও সমাবেশের স্বাধীনতা এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ড. কামাল বলেন, অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করাই হলো জনগণের মালিকানা নিশ্চিত হওয়া।
তবে আমরা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ্য করছি, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে নির্বিচারে গ্রেপ্তার, গায়েবি ও হয়রানিমূলক হাজার হাজার মামলা দায়ের, নির্যাতন, বিচারবর্হিভূত প্রাণনাশ এবং অন্যান্য বহুবিধ অন্যায় ও অবিচার ঘটে চলেছে। এসব অনতিবিলম্বে বন্ধ করার ব্যাপারে সরকারের আশু ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এটা অন্যতম ও অবিচ্ছেদ্য পূর্বশর্ত। ড. কামাল প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, গণতন্ত্রকে বলা হয় আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। বাংলাদেশের বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাসে সংলাপ আনুষ্ঠানিকভাবে সফল না হলেও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় স্বার্থে সমঝোতা বা একটা আপোসমূলক অবস্থায় পৌঁছানোর নজির আমাদের আছে। বিএনপি গোড়াতে না চাইলেও আপনার নেতৃত্বাধীন জনপ্রিয় আন্দোলনের মুখে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার সংবিধানে যুক্ত করেছিল।
আজ আমরা জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাবিষয়ক যেসব কারণে এখানে হাজির হয়েছি, সেসব নীতিগত কারণে সাম্প্রতিক অতীতেও আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের সহযোদ্ধা ছিলাম। নির্বাচনকেন্দ্রিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে ২০০৫ সালের ২২শে নভেম্বরে পল্টনের ঐতিহাসিক মহাসমাবেশে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, ১১ দল, জাসদ, ন্যাপ নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের যে লিখিত রূপরেখা দিয়েছিল, তার মধ্যকার কিছু মৌলিক বিষয় আজও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। ড. কামাল বলেন, আপনি সংবিধানসম্মত সমাধানে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু এটাও আপনার অজানা নয় যে, কোনো বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের দরকার পড়লে তা নিয়ে আলোচনা করাও সংবিধানসম্মত। কারণ সংবিধান সংশোধনের বিধান সংবিধানেরই অংশ।
তবে বিরাজমান পরিস্থিতিতে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংবিধানসম্মত একাধিক পথ খোলা আছে বলে আমরা মনে করি। ড. কামাল বলেন, এ প্রসঙ্গে আমরা আমাদের সাত দফার পাশাপাশি ১৩তম সংশোধনী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায়ের আলোকে বিশেষ করে দশম ও একাদশ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করা, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা, ২০১৩ সালে বিরোধী দলকে নির্বাচনী মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানে আপনার প্রস্তাবের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদের খ উপ দফায় সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা এবং সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদে সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের বিধান রয়েছে। সুতরাং সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা সংবিধানসম্মত এবং তা ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় রীতি মেনে চলা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অনুশীলনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।
বাংলাদেশেও ২০১৪ সালের নির্বাচনটি ব্যতিরেকে এর আগের নয়টি সংসদ নির্বাচন সংসদ ভেঙে দেওয়া অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্মৃতিচারণ করে ড. কামাল বলেন, ১৯৭৩ সালে গণপরিষদ ভেঙে দিয়েই প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বঙ্গবন্ধু সংসদের সমাপনী অধিবেশনে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, বিশ্বের বুকে তারা একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ড. কামাল বলেন, আমরা মনে করি- আজকের আলোচনায় আপনি আমাদের যথাযথভাবে আশ্বস্ত করলে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণ ও তার সামর্থ্য বৃদ্ধিকল্পে সংবিধান সম্মত একাধিক নির্দিষ্ট প্রস্তাব দ্রুততম সময়ে আমরা আপনার সদয় বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারব।
রাজনীতির লক্ষ্য হলো দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণ সাধন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও জনগণের শক্তিকেই সবচে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আপনিও জনগণের জন্য রাজনীতি করেন, আমরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও জনগণের কথা বলতে এসেছি। জনগণ ভোট দেয়ার পরিবেশ চায়, অবাধে ভোট দিতে চায়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল বলেন, আজ (১ নভেম্বর) যুব দিবস। তাই বিশেষভাবে আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, ইতিমধ্যে মোট ভোটারের অধিকাংশ যুবক। গত এক দশকেই সোয়া দুই কোটি নতুন ভোটার হয়েছে। আমরা তাদের হতাশ করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, পরিশেষে বলবো- দেশ পরিচালনার যে ঐতিহাসিক সুযোগ আপনি পেয়েছেন, সেখানে জাতীয় ঐক্য এবং রিকন্সিলিয়শন বা মেলবন্ধনে কতটা কার্যকর ভূমিকা আপনি রেখে যেতে পারছেন, আগামী দিনের মানুষ যুগযুগ ধরে সেটাই মনে রাখবে। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো রাজনীতিকদের সারাবিশ্ব শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে একটি বিবাদমান ও সংঘাতপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য।
ড. কামাল বলেন, জীবন সায়াহ্নে বঙ্গবন্ধুর একজন ক্ষুদ্র অনুসারী হিসেবে, আমি বিশ্বাস করি, জাতীয় মেলবন্ধনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আনা সম্ভব হলে তার ইতিবাচক প্রভাব জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ সবকিছুর ওপরই পড়বে। বাংলাদেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে আপনি একটি সফল সংলাপের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারেন। আর সেটা সম্ভব হলে আপনার এই উদারনৈতিক অবদানটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড়মাপের নেতাদের মতো আপনাকে অমর করে রাখবে।
এই লক্ষ্য অর্জনে আপনি সম্ভব সবধরনের পদক্ষেপ নিন। জাতির ইতিহাসে আপনার নাম সোনার হরফে লেখা থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের ঐক্যফ্রন্টের অবস্থান, প্রস্তাব এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারগুলি আমার অভিজ্ঞ সহকর্মীরা আপনাদের সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপণ করবেন। আপনার ও সহকর্মীদের সবসময়ের মতো আজও শুভ কামনা করে শেষ করছি।