আরবদের পর এবার নিজ জাতি ইহুদিদেরকে ইসরাইল থেকে বহিষ্কার করে দিচ্ছে সে দেশের সরকার। ৩৪ হাজারের বেশি আফ্রিকান উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে ইসরাইল। অথচ ইসরাইল রাষ্ট্রটিই গঠিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা উদ্বাস্তু ও গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকদের নিয়ে। তবে তারা অবশ্যই নির্দিষ্ট ধর্মের ইহুদি। আর তাই ইহুদিবাদ ছাড়া আর সবার জন্যই ইসরাইলের আচরণ একই রকম নির্মম। তারা এখন আফ্রিকান উদ্বাস্তুদের নিজ দেশে না হলেও তৃতীয় কোনো দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে ইহুদিরা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আশ্রয় দিয়েছে ইহুদিদের। আলজেরিয়া, আলবেনিয়া, তিউনিসিয়ার মুসলিমরাও নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইহুদিদের আশ্রয় দেয়ার যেসব নজির স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে অমলীন। ইরানি কূটনীতিক আবদুল হোসেইন সারদারি হাজার হাজার জার্মান ইহুদিকে ইরানি পাসপোর্টে দেশ ত্যাগ করার সুযোগ দিয়েছেন। এগুলো উদাহরণমাত্র। ইউরোপ, আফ্রিকার অনেক দেশই ইহুদিদের জীবন বাঁচাতে আশ্রয় দিয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ছিল এ ক্ষেত্রে কঠোর।
সারা বিশ্ব থেকে নির্যাতিত ইহুদিদের জন্য ভূখণ্ড করে দেয়া হয়েছে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে। সেটি অবশ্য ভিন্ন ইতিহাস। তবে উদ্বাস্তুদের নিয়ে গঠিত সেই দেশটিই আজ যখন উদ্বাস্তুদের সাথে নির্মম আচরণ করতে শুরু করেছে। ইসরাইল সরকার ঘোষণা করেছে, যেসব উদ্বাস্তু ‘স্বেচ্ছায়’ ইসরাইল ত্যাগ করবে তাদের কিছু অর্থ সহায়তা দেবে তারা। যুদ্ধবিধ্বস্ত নিজ দেশে ফিরতে না চাইলে এদের পাঠানো হবে রুয়ান্ডা কিংবা উগান্ডায়া। আর যারা ‘স্বেচ্ছায়’ যেতে না চাইবে তাদের পাঠানো হবে জোরপূর্বক, নয়তো আটকে রাখা হবে জেলে। প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছায় কেউ আর আফ্রিকায় ফিরতে চাইবে এমনটা ভুল ধারণা। যারা জেলে যাওয়ার ভয়ে আফ্রিকার সহিংসতার মধ্যে ফিরতে চাইবে তাদেরকেই দেখানো হবে ‘স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়া’ লোক হিসেবে।
ইসরাইলে বর্তমানে ৪০ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু ও অভিবাসনপ্রত্যাশীর বসবাস। বিভিন্ন সময় আফ্রিকার যুদ্ধবিগ্রহ ও দারিদ্র্য থেকে বাঁচতে তারা মিসর হয়ে ইসরাইলে প্রবেশ করেছে নিরাপদ জীবনের আশায়। জাতিসঙ্ঘের মতে ২৭ হাজার ৫০০ ইরিত্রীয় ও প্রায় ৮ হাজার দক্ষিণ সুদানি উদ্বাস্তু রয়েছে। অন্যান্য দেশেরও রয়েছে বেশ কিছু। তবে ২০১৩ সালে নেতানিয়াহু সরকার মিসরের সাথে সীমান্তে বেড়া নির্মাণের পর থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন অনেকটাই বন্ধ হয়েছে।
নেতানিয়াহু সরকারের এ ঘোষণার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইসরাইলি মানবাধিকার কর্মী ও রাব্বীদের একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতার শিকার আলোচিত জার্মান ইহুদি শিশু আনা ফ্রাঙ্কের নামানুসারে ‘আনা ফ্রাঙ্ক আশ্রয় উদ্যোগ’ নামে আফ্রিকান অভিবাসীদের থাকতে দেয়ার একটি কর্মসূচি শুরু করেছেন তারা। সচেতন আরো অনেকেই এর বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছেন। জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেল তাদের অনুষ্ঠানের ‘ক্রেডিট লাইন’ থেকে কয়েক অভিনেতার নাম বাদ দিয়েছে।
রাশিয়ান কিংবা ইরাকি উদ্বাস্তুর তৃতীয় প্রজন্ম সেই অভিনেতারা। গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের একটি গ্রুপ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে লেখা খোলাচিঠিতে বলেছে, ‘আমরা জানি উদ্বাস্তুদের কষ্ট কেমন। নিরাপদ বাসস্থান ও রাষ্ট্রই মানুষকে সহিংসতা-নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারে, কিন্তু তাদের সেটিই নেই। কিভাবে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও তার ইহুদি সরকার উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে আবার ভোগান্তি, যন্ত্রণা ও মৃত্যুশঙ্কুল সেই যাত্রায় ঠেলে দিতে পারে তা আমাদের বুঝে আসে না।’
তবে ইসরাইল সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল। তারা বলছে, এ বিতাড়ন কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক আইনের ব্যত্যয় ঘটবে না। আরো বলছে, উদ্বাস্তুদের সুদান কিংবা ইরিত্রিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে ফেরত পাঠানো হবে না। যারা রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবে না, শুধু তাদেরই ফেরত পাঠানো হবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নেতানিয়াহু সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার মানসিকতা খুবই কঠোর। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইসরাইল রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টিকে লাল ফিতায় বন্দী করে রেখেছে। এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন থেকে তারা মঞ্জুর করেছে মাত্র ১২টি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে ইসরাইল কিছুটা নমনীয় হয়েছে। তারা শুধু অবিবাহিত উদ্বাস্তুদের প্রাথমিকভাবে দেশ ছাড়া করবে বলে জানিয়েছে। তবে অন্যদের স্থায়ীভাবে রাখার কথা বলছে না। রুয়ান্ডা ও উগান্ডায় পাঠানোর বিষয়ে দেশ দু’টির সরকারের সাথে চুক্তি হয়েছে বলেও প্রচার করছে নেতানিয়াহু সরকার। তবে রুয়ান্ডা ও উগান্ডা এমন কোনো চুক্তির কথা অস্বীকার করেছে। আফ্রিকা মহাদেশে ইসরাইলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র রুয়ান্ডা জানিয়েছে, তারা কোনো উদ্বাস্তু গ্রহণ করবে না।
নেতানিয়াহু সরকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাল হিসেবেও ব্যবহার করছে উদ্বাস্তু ইস্যুটিকে। তাদের ভোটাররা উদ্বাস্তুদের বিতাড়িত করার পক্ষে, তা ছাড়া বিরোধী দলগুলো বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। গত বছর গুলাপ নামে একটি জরিপ ও গবেষণা সংস্থার অভিবাসী গ্রহণের সূচকে ইসরাইলের অবস্থান হয়েছে একেবারে নিচের দিকে। দেশটির নাগরিকদের বড় একটি অংশ মনে করছে অভিবাসী বা উদ্বাস্তুরা অপরাধের সাথে জড়িত, কেউ মনে করছে এই লোকগুলো আশ্রয় পেলে ইহুদি রাষ্ট্রটির অবস্থান দুর্বল হয়ে যেতে পারে। বিচারমন্ত্রী আয়েলেত শাকেদ তো বলেই দিয়েছেন, ‘ইসরাইল আফ্রিকানদের জন্য কোনো চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান নয়’। কট্টর ইহুদিবাদী এ নেতার মতোই বেশির ভাগ লোকের মনোভাব। অথচ এই অভিবাসীরা ইসরাইলের শ্রমবাজারের জন্য বড় সম্পদ হতে পারে। দেশটিতে রয়েছে প্রচুর শ্রমিক সঙ্কট।
অভিবাসন ইস্যুটি নিয়ে ইসরাইলের কট্টরপন্থী ইহুদি ও উদাপন্থীদের মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব ইহুদিরা নিজেদের ও পূর্বপুরুষের অতীত সম্পর্কে সচেতন তারা চাইছেন ইহুদিবাদকে মানবিক ও দাতব্যবান্ধব হিসেবে পরিচিত করাতে।
আরেকটি ভিন্ন চিত্র হচ্ছে, ইসরাইল প্রতি বছরই বিদেশী ইহুদিদের গণহারে আশ্রয় দিচ্ছে। বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে ইহুদিরা চাওয়া মাত্রই ইসরাইলের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। শুধু ২০১৭ সালেই ২৭ হাজার ইহুদি আশ্রয় নিয়েছে দেশটিতে। অর্থাৎ ইহুদি ও অ-ইহুদিদের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়ম সেখানে। এক দিকে উদারতা, অন্য দিকে নির্মমতা। নির্দিষ্ট ধর্মের লোক হলেই মিলছে আশ্রয়, আর অন্যদের চলছে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা।