ময়মনসিংহের ক্ষতিকর বাতাসে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি

মো. আব্দুল কাইয়ুম : ময়মনসিংহে ক্ষতিকর বাতাসের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়তে পারে। সাম্প্রতিক পরিবেশ বিষয়ক একাধিক জরিপে বাংলাদেশের যেসব শহরের বাতাসকে ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে সেখানে ময়মনসিংহের নামও রয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এদিকে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের মাত্রা যেখানে বেশি সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি। দূষিত বায়ুতে মানুষের মাঝে আত্মহত্নার প্রবণতা বাড়ে এ বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণা করেছে লন্ডনস গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। তাদের ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এবিষয়ে একটি আর্টিকেল ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। যার লিংক Depression and suicide risk linked to air pollution

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে বৈধমাত্রা সে অনুপাতে বৈশ্বিক দূষণ কমিয়ে আনলে কোটি কোটি মানুষকে হতাশাগ্রস্ত হওয়া থেকে ফেরানো যাবে। দূষিত বায়ুর কারণে মানুষের মধ্যে এই হতাশাবোধ সৃষ্টি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পার্সপেক্টিভস সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি তৈরিতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত ১৬ দেশের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, দূষিত বায়ুর সঙ্গে হতাশা ও আত্মহত্যার একটি সম্পর্ক রয়েছে।

সম্প্রতি আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দূষিতবায়ুর সঙ্গে মানসিকভাবে অসুস্থ লোকদের মৃত্যুর সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া দূষণের কারণে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে চার গুণ।

গবেষক দলের সদস্য ইসোবেল ব্রেইথওয়েইট বলেন, ‘আমরা জানি দূষিতবায়ুর সবচেয়ে ভালো কণাটিও রক্তপ্রবাহ ও নাক দিয়ে মস্তিস্কে পৌঁছায়। এই বায়ু দূষণের কারণে মস্তিস্কে প্রদাহ দেখা দেয়, নার্ভ সেলের ক্ষতি হয় এবং স্ট্রেস হরমোনের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, যার সঙ্গে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে’।

পরিবেশ বিষয়ক একাধিক জরিপে বায়ুদূষণের কারণে ময়মনসিংহকে খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

এদিকে শহরের ময়লাকান্দার দূষিত পরিবেশের জন্য এখনও আন্ত:বিভাগের কয়েক কোটি মানুষসহ স্থানীয়রা প্রতিনিয়ত চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সেই সাথে জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ছে। ময়লাকান্দার দূষিত বাতাস থেকে রেহাই পাচ্ছেনা শহরবাসী। বিশেষ করে ময়লাকান্দার দূষিত বায়ু ময়মনসিংহ শহরসহ চরাঞ্চলের মানুষের জন্য এক ধরণের অভিশাপ। ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা-জামালপুরের মানুষ যারা নিত্যদিন ময়মনসিংহ শহরমুখী হচ্ছেন তারাও রেহাই পাচ্ছেনা এ অসহায়ত্ব থেকে।

সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ শহরে ছয় লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করায় প্রতিদিন গড়ে ১৮০ মেট্টিক টন ময়লা-আবর্জনা তৈরি হয়। আর পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়েই শহরের সমস্ত ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় শহরতলীর চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নের চর কালিবাড়িতে। ১৯৯৫ সালে বর্তমান নগর কর্তৃপক্ষ ময়লাকান্দার তিন একর জমি কেনেন বাসস্ট্যান্ড স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে। যদিওবা অজ্ঞাত কারণে এখনই ময়লাকান্দায় বাসস্ট্যান্ড স্থানান্তরের কোন পরিকল্পনা নেই কর্তৃপক্ষের। আর এই ময়লাকান্দার ময়লা থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণে নাজেহাল জীবন যাপন করতে হচ্ছে স্থানীয়দের। বায়ু দূষণের কারণে ময়লাকান্দা এলাকার প্রায় ৬ হাজার মানুষ চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মশা-মাছির উপদ্রুবের সাথে অসহনীয় দুর্গন্ধের কবল থেকে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। পথচারীরা সাময়িকভাবে দমবন্ধ করে চলাচল করলেও সিটি কর্পোরেশনের দেয়া নিত্যদিনের উপহার ‘দুর্গন্ধ’কে সুগন্ধি হিসেবে মেনে নিতে হচ্ছে সবাইকে। যদিওবা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এই ময়লাকান্দা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন। তবে কবে নাগাদ এই ময়লাকান্দা বদলে যাবে তা নিয়ে সন্দিহান শহরবাসী। আপাতত ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে হলেও দুর্গন্ধ থেকে কিছুটা রক্ষা দিতে পারে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন।

চিকিৎসকরাও বলছেন যে, বাতাসে ভারি ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তকণা বেড়ে গেলে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। দেশের বায়ু দূষণের অবস্থা একদিকে দিন দিন খারাপ হচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। ধুলা আর যানবাহনের কালো ধোঁয়াতে বেশি বায়ুদূষণ হচ্ছে শহরের পাটগুদাম ব্রিজ মোড় এলাকায়। বায়ুদূষণ রোধে মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সেই সাথে ময়মনসিংহ শহরসহ আশপাশের উপজেলাগুলোতে বাতাসে ধূলির সূক্ষ্ম বস্তকণা বেড়ে যাচ্ছে যা এই জড়িপ থেকে বুঝা যায়। দূষণ ঠেকাতে শহরের আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার জরুরি। সেই সাথে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় ধূলাবালি নিবারণে কর্তৃপক্ষের স্থায়ী উদ্যোগ নেয়া জরুরী।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর উপ-পরিচালক ডা. লক্ষী নারায়ণ মজুমদার ময়মনসিংহ লাইভকে বলেন, ময়মনসিংহ শহরে দূষিত বায়ুর কারণে শ্বাসতন্ত্রের রোগীর সংখ্যা উত্তরোত্তর হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর শহরের  ময়লাকান্দার যে দূষিত-আবর্জনার যে স্তুপটি রয়েছে তা সম্পূর্ণই অস্বাস্থ্যকর। এই ময়লাকান্দা থেকেও দূষিত বায়ু সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ময়মনসিংহের পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নূর আলম ময়মনসিংহ লাইভকে জানান, ময়মনসিংহ শহরে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ শহরের ময়লাকান্দা। এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বনডাইঅক্সাইড ও মিথেণ গ্যাস সৃষ্টি হওয়ায় অকল্পনীয় হারে বায়ু দূষণ হচ্ছে। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২৫ টি ইট ভাটা রয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কোন ইটভাটা নিষিদ্ধ থাকলেও এসব ইট ভাটায় ইট পোড়ানো হচ্ছে। তাছাড়া শহরের বাসস্ট্যান্ডগুলোতে যানবাহনের কালো ধোঁয়া থেকেও বায়ু দূষিত হচ্ছে। ময়মনসিংহ শহরের ময়লাকান্দা নিয়ে বেশ কয়েকবার সিটি কর্পোরেশন এর সাথে কথা বলেছেন বলেও জানান তিনি।

ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ময়মনসিংহ লাইভকে বলেন, শহরের ময়লাকান্দা থেকে বায়ু দূষণ হচ্ছে তা ঠিক কিন্তু এব্যাপারে সিটি কর্পোরেশন শীঘ্রই আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। তবে বায়ু দূষণ রোধে সকলকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার পরার্শও দেন তিনি। শীঘ্রই ময়লাকান্দায় টিন শেড ও ওয়াল দিয়ে বায়ু দূষন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

Share this post

scroll to top