কৃষি জমির ওপর কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান নয় : প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের উন্নয়ন এখনো অনেকাংশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবাদী জমির ক্ষতিসাধন করে যত্রতত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না তোলার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেশের উন্নয়নের জন্য শিল্পায়নে যাব। কিন্তু কৃষিকে বাদ দিয়ে নয়। কেননা, আমাদের দেশের উন্নয়ন এখনও অনেকাংশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।’

তিনি বলেন, ‘তিন ফসলী জমিতেতো ইন্ডাস্ট্রি করতেই পারবে না। আর যদি এক ফসলী জমি, যেখানে চাষ হয় না সেখানে হবে। তবে, যত্রতত্র করতে পারবে না।’

প্রধানমন্ত্রী আজ বেলা ১১টায় রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ কৃষকলীগের ১০ জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।

তাঁর সরকারের একশ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটার অর্থ হলো আমাদের কোন কৃষি জমি যাতে নষ্ট না হয়। যেখানে সেখানে যত্রতত্র এটা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে, এটা কেউ করতে পারবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে চায় তাদেরকে ওই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সব ধরনের সার্ভিস সেখানে দেওয়া হবে। কাজেই তাঁরা সেখানে শিল্প গড়ে তুলবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘কৃষি জমি বাঁচাতে হবে। কারণ, ১৬ কোটির ওপর মানুষকে আমাদের খাবার দিতে হবে। অবশ্য আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় এখন পুষ্টির দিকে নজর দিয়েছি। ডিম, মাংস, মিঠা পানির মাছ, তরিতরকারি এবং ধান উৎপাদনে তাঁর সরকারের সাফল্যও এ সময় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর সরকারের ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ কর্মসূচির উল্লেখ করে যার যার বাড়িকে তার তার খামারে পরিণত করার আহবান জানান শেখ হাসিনা ।
তিনি বলেন, ‘কেউ বসে থাকবে কেন, সবাই কাজ করবে। যে যেভাবে উৎপাদন করতে চায়, যা উৎপাদন করতে চায়। আমরা সেই সুযোগটা দেব এক টুকরো জমিও অনাবাদী থাকবে না।’

‘অনাচে, কানাচে, ঘরের পাশে, জলা, ডোবা যাই থাকুক এমনকি ছাদের ওপরে পর্যন্ত যেন চাষ হয় এবং ফসল উৎপাদন হয় এবং কৃষকরা ভিটেবাড়িতেও যেন ফসল উৎপাদন করতে পারে সেজন্য আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পটি আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি’, যোগ করেন তিনি।
এ সময় তাঁর সরকারের পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক করে দেওয়ায় তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী উৎপাদিত পণ্য সমবায়ের মাধ্যমে বাজারজাতকরণের উদ্যোগর উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।
অন্যান্যের মধ্যে-বাংলাদেশ কৃষক লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুল হক রেজা এবং সহ-সভাপতি শরিফ আশরাফ হোসেন বক্তৃতা করেন।

কৃষকলীগের যুগ্ম সম্পাদক সমির চন্দ্রের সঞ্চালনায় সর্ব ভারতীয় কিষাণ সভা’র সাধারণ সম্পাদক অতুল কুমার অঞ্জন ও বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।
আলোচনা পর্বের আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এর আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চার জাতীয় নেতা, স্বাধীনতা যুদ্ধসহ সকল গণআন্দোলনের শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

তার সরকার গবেষণার জন্য বাজেট বরাদ্দসহ গবেষণায় অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ফসল বহুমুখীকরণের অংশ হিসেবে ১০৮ ধরনের উচ্চফলনশীল ধানের জাত আবিষ্কার করেছি। লবণাক্ততা সহিষ্ণু, ক্ষরা সহিষ্ণু এবং বন্যার পানি সহিষ্ণু ধান এবং কৃষিকে যান্ত্রিকিকরণের অংশ হিসেবে ৪৪২ ধরনের কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছি।’

তিনি আক্ষেপ করেন, একটু সমস্যা রয়েছে, আমাদের যারা লেখাপড়া শেখে তাদের মধ্যে অনেকেই কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও লেখাপড়া শিখে আর মাঠে যেতে চায় না।

তিনি বলেন, যে বাবা কৃষি কাজ করে তাঁকে লেখাপড়া শিখিয়েছে তখন সেই বাবারই ছেলেকে নিয়ে মাঠে যাওয়া উচিত। অথচ দুই পাতা লেখাপড়া শিখেই তারা মনে করে আমি কেন মাঠে যাব। আমার মনে হয়, ঐ ছেলেটা থেকে আমাদের দূরে থাকার দরকার।

প্রধানমন্ত্রী এবার ধানকাটার মওসুমে ছাত্রলীগকে মাঠে গিয়ে ধান কাটার কাজে কৃষকদের সহায়তার আহ্বান জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে বলেন, ‘এতে লজ্জার কিছু নেই। নিজের কাজ নিজে করায় লজ্জার কিছু থাকে না।’ ‘নিজের ফসল নিজে উৎপাদন করবো। নিজের খাবার নিজে খাব। এতে লজ্জার কি আছে,’ বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমিও আমার (গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার) কৃষকদের বলে দিয়েছি তোমরা যখন বীজ রোপণ করবা আমাকে খবর দিও প্রয়োজনে আমিও যাব।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই জায়গাটায় আমাদের কৃষকলীগের একটা ভূমিকা থাকা দরকার এবং আমি মনে করি, আমাদের স্কুল জীবন থেকেই এটা অভ্যাস থাকা দরকার। কেননা, জমি চাষ করা, নিজের ফসল নিজে ঘরে তোলাটা একটা গর্বের বিষয়। এটাকে সেভাবেই দেখতে হবে এবং মর্যাদা দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘কৃষি কাজকে মর্যাদা না দিলে পেটের ভাত বা খাবার আসবে কোথা থেকে। সেকথাটাও ভাবতে হবে।’ সরকারের উদ্যোগে মৎস, চিংড়ি, ভুট্টা এবং বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এজন্য এখন বারো মাসই সকল প্রকার সবজি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। যা অতীতে কেবল শীতকালেই পাওয়া যেত।

দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টার এবং ইন্টারনেট সেবাকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁর সরকার ডিজিটাল কৃষির প্রবর্তণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাড়ে ৩ হাজার ইউনিয়নে আমরা পৌঁছে গেছি এবং ইনশাল্লাহ অচিরেই আমাদের সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়নেও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে যাবে।’

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাই-১ উৎক্ষেপণ, ই-কৃষি চালু, কৃষকদের জন্য কল সেন্টার চালু, ৪৯৯টি কৃষি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন এবং সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন তিনি।

তাঁর সরকারের মোবাইল ফোনকে বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দেওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক স্বল্পমূল্যে কৃষকরা মোবাইল ফোন ক্রয় করে সরকারের বিভিন্ন ডিজিটাল সেবা নিতে পারছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

বিএনপি সরকারের সময়ে ন্যায্যমূল্যের সারের দাবিতে আন্দোলররত ১৮ জন কৃষককে হত্যার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি’র আমলে ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করা হলো। তাঁদের অপরাধ তাঁরা চাষ করতে পারছে না, তাই, সার চাইছে। আর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই তাঁর প্রথম মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সারের দাম কমালো। মোট চার দফা দাম কমিয়েছিল আওয়ামী লীগ।’

‘কেননা আমরা সারে ভতুর্কি দিচ্ছি। উচ্চমূল্যে সার কিনে নি¤œমূল্যে তা কৃষকের কাছে সরবরাহ করছি, ’যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ’৭৫ এর জাতির পিতাকে হত্যার পর শুধু দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারই হরণ করা হয় নাই বেঁচে থাকার সব অধিকার একে একে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।’

কৃষকদের মধ্যে ন্যায্যমূল্যে বীজ সরবরাহের জন্য বঙ্গবন্ধুর চালু করে যাওয়া ‘বিএডিসি’কে অলাভজনক দেখিয়ে বিএনপি সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল উল্লেখ করে বিএনপি’র কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘সব সময় লাভ-লোকসান দেখলে চলে না, কোনটা আমার দেশের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। কোনটাতে দেশের মানুষ বেশি উপকার পাবে সেটাই আমাদের দেখতে হবে। যে কারণে ’২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগ কৃষিকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছিল।’
সরকার প্রধান বলেন, বর্গাচাষিদের জন্য কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে বিনা জামানতে, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ প্রদান চালু করে তাঁর সরকার এবং যার ফল স্বরূপ কৃষির সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

তার দল ২৬ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতি নিয়ে ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবার ২০০১ সালে যখন ক্ষমতা ছেড়ে যায় তখন ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত রেখে যায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা আসলে একটা নীতির বিষয়। বিএনপি কখনও চাইতো না বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক। কারণ, তাহলে নাকি বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ দেশকে পরনির্ভরশীল করে রাখাই ছিল বিএনপি’র নীতি।

’৯৬ পরবর্তী সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত বক্তব্য- ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া ভাল নয়, তাহলে বিদেশি সাহায্য পাওয়া যাবে না’র উদ্ধৃতি উদাহারণ হিসেবে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘যে কারণে ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার পূণরায় ক্ষমতা ছাড়ার সময় দেশকে আবারো খাদ্য ঘাটতির দেশ বানিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু আমরা তখন বললাম জাতির পিতা বলেছিলেন, ভিক্ষুক জাতির কোন ইজ্জত থাকে না। কাজেই আমরা ভিক্ষুক জাতি হতে চাই না। আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হব এবং নিজের পায়ে দাঁড়াবো।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতার বিখ্যাত উক্তি ‘আমার মাটি আছে, মানুষ আছে, সুতরাং এই মাটি ও মানুষ দিয়েই এদেশকে গড়ে তুলবো’ উল্লেখ করে বলেন, যে কারণে বাংলাদেশ আজ কেবল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, উদ্বৃত্ত খাদ্যেরও দেশ।’

তাঁর সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৫ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অগ্রাহ্য করেও কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে। অথচ যে প্রেসক্রিপশন মেনে নিয়েছিল বিএনপি।

তিনি বলেন, তাঁর সরকার ২০১৯-২০ সালের বাজেটে কৃষি খাতের জন্য ১৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে, কৃষি প্রণোদনা এবং পুণর্বাসন চালুর অংশ হিসেবে এক হাজার ২৭ কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। যার মাধ্যমে ৭৯ লাখ ৯৬ হাজার ২৭৬ জন কৃষক উপকৃত হচ্ছে। তাছাড়া, ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার কৃষকের মাঝে কৃষি উপকরণ কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।

কৃষকদের ১০ টাকা মূল্যে ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছে তাঁর সরকার, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে সরাসরি ভর্তুকির টাকা কৃষকদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রায় এক কোটির ওপর কৃষকদের এই ব্যাংক একাউন্ট খোলারও তথ্য দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের প্রবৃদ্ধি আজ ৮ দশমিক ১৩। এর পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের।

তিনি বলেন, হাওর এলাকার কৃষকরা অকাল বন্যায় প্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার কৃষকরাও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। তাদের জন্য কোনো বীমা ব্যবস্থা চালু করা যায় কি-না সেটাও আমাদের সরকার ভাবছে। বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে। এ অর্জন আমাদের ধরে রাখতে হবে।

দেশে কৃষির উন্নয়ন এবং কৃষকের স্বার্থ রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশ কৃষকলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির সর্বশেষ কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয় ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। সূত্র : বাসস

Share this post

scroll to top