মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের সক্রিয় ভূমিকার কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অবস্থান পরিবর্তন করেছে ভারত ও জাপান। আঞ্চলিক স্বার্থে রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন চেয়েছে ভারত। অন্য দিকে রাখাইন রাজ্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্তে মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাপান।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ থাকলেও ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে চীন। ভেটো ক্ষমতাধর চীনের বিরোধিতার কারণে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় না। বাংলাদেশের অব্যাহত তাগাদার কারণে সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় একটি কাঠামোর আওতায় আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার। চীন ও মিয়ানমারের দুই রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ত্রিদেশীয় যৌথ কার্যকরী গ্রুপ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে।
মিয়ানমারে ভারত ও জাপানেরও ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। তাই বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে এই ইস্যুতে মিয়ানমারের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে চায় দেশ দু’টি। তবে চীনের পাশাপাশি সম্প্রতি ভারত ও জাপানও এ ইস্যুতে তাদের অবস্থানে পরিবর্তন আনছে। চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য ঠেকাতে দেশ দু’টি এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রকাশ্যে একটি অবস্থানে পৌঁছতে চাচ্ছে।
এর আগে ভারত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সরবরাহ ও রাখাইনে প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুকদের জন্য ঘর বানানোর দিকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। এবারই প্রথম আঞ্চলিক স্বার্থে প্রত্যাবাসনের ওপর সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে জোর দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে জাপান রোহিঙ্গা সঙ্কটের সুরাহায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চাইলেও নৃশংসতার সাথে জড়িত মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল। এখন শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে গত শনিবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান সম্মেলনের সাইডলাইনে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর অং সান সু চির সাথে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বৈঠকে মোদি আঞ্চলিক, বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারÑ এই তিন দেশের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়েছেন।
সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে লেখা এক চিঠিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ঢাকার পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত মনে করে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এই অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
সু চি গত মাসে জাপানের রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে টোকিও গিয়েছিলেন। এ সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। আবে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যবাসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সু চির প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এ রাজ্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্তে মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীকে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার তাগাদা দেন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চীন ও ভারতের স্বার্থ গভীরভাবে সম্পৃক্ত। রাখাইনে বন্দর স্থাপন করে আমদানি করা জ্বালানি তেল ভূমিবেষ্টিত কুনমিং পর্যন্ত নেয়ার জন্য পাইপলাইন স্থাপন করেছে চীন। পাশাপাশি আরো একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে রাখাইন থেকে কুনমিংয়ে গ্যাস নেয়া হচ্ছে। আর ভারত কালাদান প্রকল্পের আওতায় রাখাইনের রাজধানী সিত্বেয় বন্দর স্থাপন করে নদী ও সড়ক পথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামে যোগাযোগ স্থাপন করছে। উদ্দেশ্যÑ ভারতের ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য সহজে পণ্য আমদানি-রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করা। চীন ও ভারত রাখাইনে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায়ও রয়েছে। অন্য দিকে জাপানের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে মিয়ানামারে। অর্থনৈতিক এ প্রতিযোগিতা থেকে জাপানও পিছিয়ে পড়তে চায় না।
ব্যাংককে সদস্য সমাপ্ত আসিয়ান সম্মেলন শেষে জোটটির চেয়ারম্যানের দেয়া বিবৃতিতে রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষদের মানবিক সহায়তা, প্রত্যাবাসন ও রাজ্যের টেকসই উন্নয়নে জোটের আরো দৃশ্যমান ও জোরালো ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চলমান সংলাপকে উৎসাহিত করেছে আসিয়ান। এ লক্ষ্যে চীনের মধ্যস্থতাকেও স্বাগত জানানো হয়েছে।