এই ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচন আবারো ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রান্তিকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষটিতে এই সম্প্রদায়ের এমপিদের সংখ্যা খুবই কম। এই প্রক্রিয়া সম্প্রদায়টির সামাজিক-অর্থনৈতিক খাতে সুস্পষ্ট প্রান্তিকরণের মতোই দৃশ্যমান। ২০০৫ সালে সাচার কমিটি তার প্রতিবেদন দাখিল করার পর থেকেই দলিত ও হিন্দু অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণির (ওবিসি) কাছে হেরে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক ‘চেপে যাওয়া’ এনএসএসও প্রতিবেদন (পিএলএফএস-২০১৮) ও এনএসএস-ইইউএস (২০১১-১২) ব্যবহার করে ভারতের অন্যান্য সামাজিক গ্রুপের সাথে মুসলিম তরুণদের আর্থসামাজিক অবস্থা পরীক্ষা করা হয়। আমরা তিনটি চলক ব্যবহার করেছি : স্নাতক সম্পন্নকারী শিক্ষিত মুসলিম তরুণের হার (২১-২৯ বছর), শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্প্রদায়টির তরুণদের হার (১৫-২৪ বছর) এবং এনইইটি শ্রেণিতে (চাকরি, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে নয়) মুসলিম তরুণদের হার। এসব চলক সম্মিলিতভাবে দেশের তরুণদের শিক্ষাগত গতিশীলতার পর্থনির্দেশনা প্রতিফলন করে।
হিন্দি বলয়ে মুসলিম তরুণদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তাদের শিক্ষা লাভ হরিয়ানায় সবচেয়ে কম, ২০১৭-১৮ সময়কালে ছিল ৩ ভাগ, রাজস্থানে ৭ ভাগ, উত্তর প্রদেশে ১১ ভাগ। উত্তর ভারতের একমাত্র মধ্য প্রদেশেই মুসলিমদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। এখানে তা ১৭ ভাগ। মধ্য প্রদেশ ছাড়া এসব রাজ্যে দলিতদের চেয়ে পিছিয়ে আছে মুসলিমরা। শিক্ষা লাভের দিক থেকে দলিত ও মুসলিমদের পার্থ হরিয়ানা ১২ ভাগ, উত্তর প্রদেশে ৭ ভাগ। ২০১১-১২ সময়কালে এসব রাজ্যে দলিতরা এই দিক থেকে সামান্য এগিয়ে ছিল।
পূর্ব ভারতে মুসলিম তরুণদের শিক্ষা লাভ : বিহারে ৮ ভাগ, দলিতদের ৭ ভাগ; পশ্চিম বঙ্গে ৮ ভাগ, দলিত ৯ ভাগ; আসামে ৭ ভাগ, দলিত ৮ ভাগ। গত ছয় বছরে মুসলিম ও দলিতদের মধ্যকার ব্যবধান কমে এলেও দলিতরা অনেক ভালো করছে।
পশ্চিম ভারতে ২০১১-১২ সময়কালে মুসলিমরা শিক্ষা লাভের দিক থেকে ভালো ছিল। কিন্তু দলিত ও হিন্দু ওবিসির সাথে তুলনা করলে ভালো মনে হবে না। গুজরাটে ২০১৭-১৮ সালে মুসলিম ও দলিতদের মধ্যে পার্থক্য চিল ১৪ ভাগ। ছয বছর আগে তা ছিল মাত্র ৮ ভাগ। মহারাষ্ট্রে ২০১১-১২ সালে দলিতদের চেয়ে মুসলিমেরা কিছুটা (২ ভাগ) ভালো ছিল। কিন্তু এখন মুসলিমেরা ৮ ভাগ পিছিয়ে পড়েছে।
তামিল নাড়ুতে মুসলিমেরা সারা ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এখানে মুসলিমেরা ৩৬ ভাগ শিক্ষা লাভ করেছে। কেরালায় ২৮ ভাগ, অন্ধ্র প্রদেশে ২১ ভাগ, কর্নাটকে ১৮ ভাগ মুসলিম তরুণ স্নাতক। তামিল নাড়ু ও অন্ধ্র প্রদেশে দলিতদের সাথে মুসলিমেরা প্রতিযোগিতা করলেও কেরালায় পিছিয়ে পড়ছে। দক্ষিণ ভারতে মুসলিমের দ্রুততার সাথে পিছিয়ে পড়ছে দলিত ও ওবিসিদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার কারণে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তরুণদের বর্তমান উপস্থিতিবিষয়ক পরিসংখ্যান বিবেচনা করলে আর্থ-সামাজিক খাতে মুসলিমদের কোণঠাসা হয়ে পড়ার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া তরুণদের মধ্যে মুসলিমদের হার সবচেয়ে ম। ১৫-২৪ বয়সী গ্রুপে এই সম্প্রদায়ের মাত্র ৩৯ ভাগ সদস্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। অথচ দলিতদের মধ্যে তা ৪৪ ভাগ, হিন্দু ওবিসিতে ৫১ ভাগ, হিন্দু উচ্চ শ্রেণির সদস্য ৫৯ ভাগ।
মুসলিম তরুণদের একটি বড় অংশই আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ত্যাগ করে এনইইটি শ্রেণিতে চলে যাচ্ছে। মুসলিম তরুণদের ৩১ ভাগ এই শ্রেণিতে পড়ে। ভারতে যেকোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ। এর পর আছে দলিতদের ২৬ ভাগ, হিন্দু ওবিসি ২৩ ভাগ, উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে ১৭ ভাগ। হিন্দি বেল্টে বিষয়টি প্রকট। রাজস্থানে এনইইটির আওতায় মুসলিমদের হার ৩৮ ভাগ, উত্তর প্রদেশ ও হরিয়ানায় ৩৭ ভাগ, মধ্যপ্রদেশে ৩৫ ভাগ। দক্ষিণ ভারতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বাদ পড়া হার তুলনামূলকভাবে কম : তেলেঙ্গানায় ১৭ ভাগ, কেরালায় ১৯ ভাগ, তামিল নাড়ুতে ২৪ ভাগ, অন্ধ্র প্রদেশে ২৭ ভাগ।
মুসলিমদের প্রান্তিক হয়ে পড়াটা কয়েক বছর আগে শুরু হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা প্রকট হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। ‘ইন্টারজেনারেশনাল মোবিলিটি ইন ইন্ডিয়া :এস্টিমেটস ফ্রম নিউ মেথডস অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডাটা’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মুসলিমেরা যেখানে দ্রুত শিক্ষা চলমানতা থেকে বের হয়ে পড়ছে, সেখানে দলিতরা তাতে বেশি করে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এই সমস্যাপূর্ণ প্রক্রিয়ার সাথে মুসলিমদের রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ার সম্পর্ক জানার জন্য আরো গবেষণা প্রয়োজন। নজরদারি গ্রুপগুলোর কার্যক্রম সম্ভবত মুসলিম তরুণদেরকে তাদের খোলস থেকে বের করতে পারে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস/এসএএম