বিদেশে কাজ করতে যান, বিশেষ করে ইউরোপ বা আমেরিকায়, এমন কারো কাছে ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ শব্দটি খুব পরিচিত একটি শব্দ। এটি একটি চুক্তির নাম।
এই মুহূর্তে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলাদেশী শ্রমিকেরা বিদেশে যান, তার একটি অংশ যাচ্ছেন ঝুঁকি নিয়ে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া। এই বডি কন্ট্রাক্ট বা শরীর চুক্তি হয় কেবলমাত্র তাদের সাথে।
এভাবে বিদেশে যাবার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নেন একজন মানুষ। কেউ সাগরে ডুবে প্রাণ হারান, কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হন, কেউ আবার পড়েন অপহরণকারীর খপ্পরে। তবে কেউ কেউ ভাগ্যক্রমে এভাবেই পৌঁছে যান প্রতিশ্রুত গন্তব্যে।
বডি কন্ট্রাক্ট কী
এই ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ বা শরীর চুক্তির মানে হলো একজন এজেন্ট তখনই হাতে টাকা পাবে, যখন একজন শ্রমিক প্রতিশ্রুত গন্তব্যে পৌঁছুবেন।
অর্থাৎ একজন বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তির শরীর গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হবে এটাই এই চুক্তির প্রধান শর্ত, পৌঁছালে টাকা তুলে দিতে হবে এজেন্টের হাতে। গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারলে কোনো টাকা দিতে হবে না।
তবে প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরলে অনেক সময়ই এজেন্ট বা দালাল বা পাচারকারী অর্থ ফেরত দেন না।
এখানে প্রধান বিষয় হচ্ছে, বডি কন্ট্রাক্ট হয় অবৈধভাবে অনিশ্চিত রুটে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এজেন্ট রবিউল আহমেদ, যিনি তার প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে চাননি, তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “কন্ট্রাক্ট ভিসা মানে হলো ভিসা পাবার আগে যাবতীয় খরচ এজেন্টের”।
“অর্থাৎ ভিসা ফি, স্পন্সর, বিমান ও স্থল বা নৌপথে পরিবহনের খরচ ভাড়া, বিভিন্ন চেকপয়েন্টে যেসব জায়গায় টাকা দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করা হবে, সে সবই এজেন্ট দেবেন।”
আহমেদ জানিয়েছেন, টাকা পরে নেবার যুক্তি হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন, কারণ ঠিক জায়গামতো না পৌছাতে পারলে, পরে আর লোক পাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয়ত টাকা নিয়ে ব্যর্থ হলে, লোকে টাকা দেবে না পরে।
২০১৯ সালে এ পর্যন্ত ৯ জনকে এই চুক্তিতে তিনি আমেরিকা ও স্পেনে পাঠিয়েছেন।
তিনি স্বীকার করেছেন, বডি কন্ট্রাক্টে খরচ বেশি হয় বৈধ পদ্ধতির চেয়ে।
“কারণ আপনার ঝুঁকিও তো বেশি। খালি ভিসা পাইলেই তো কেউ টাকা শোধ দেয় না, ওই দেশে ঢুকলে পরে টাকা দেয় আমাদের। আর যদি কোনোভাবে অ্যাক্সিডেন্ট হয় (মারা যায় যদি) তাহলে টাকা তো পাবই না, উল্টা পুলিশ কেস হয়।”
ঝুঁকি সম্পর্কে কতটা জানেন বিদেশ গমনেচ্ছু?
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ ইউরোপ ও আমেরিকায় যায়।
এদের বড় অংশটি যায় কন্ট্রাক্ট ভিসা বা যেটি স্থানীয়ভাবে বডি কন্ট্রাক্ট নামে পরিচিত, সেই পদ্ধতিতে।
ঝুঁকি নিয়ে হলেও কেন বাংলাদেশিরা ইউরোপে যেতে চান? দালাল চক্র কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে তাদের?
সোনাইমুড়ির রফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) জানান, গত দুই বছর ব্যবসায় লোকসান করার পর তার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তার ছোটভাইকে বিদেশে পাঠানোর।
এক বছর আগে তার ১৭ বছর বয়সী ছোট ভাই এজেন্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে যাবার জন্য প্রথমে বাংলাদেশ থেকে বৈধ ভিসায় ব্রাজিলে যান।
“এরপর দালাল (এজেন্ট) সেখান থেকে আরেক এজেন্টের কাছে হস্তান্তর করছে। তার মাধ্যমে কলম্বিয়া, কলম্বিয়া থেকে পানামা গেছে। পানামার মধ্যে আমাজন জঙ্গলের অংশটি হেঁটে পার হয়েছে আমার ভাই। অন্য সবখানে বর্ডার গার্ডদের সাথে কন্ট্রাক্ট ছিল আমাদের দালালের। সেখান থেকে মেক্সিকো সীমান্ত হয়ে আমেরিকা ঢুকছে আমার ভাই।”
এই পথে কয়েক জায়গাতেই তার ভাই ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, কয়েক দিন জেল খেটে বেরও হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পর তার ভাইকে সাত মাস জেল খাটতে হয়, কিন্তু চাইল্ড প্রটেকশন আইনের আওতায় পরে একজন স্থানীয় অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে মুক্তি পেয়েছেন।
“সব মিলে মোট ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে আমাদের। ব্রাজিল পর্যন্ত যেতে যে খরচ সেটা আমার ভাই দেশ ছাড়ার আগেই দিতে হয়েছে, সেটা দুই লাখ বা তিন লাখ টাকা।
এরপর সেখান থেকে কলম্বিয়া যাবার পর দালালকে দুই লাখ টাকা, কলম্বিয়া থেকে পানামা যাওয়ার পর দিয়েছি তিন লাখ টাকা এভাবে ধাপে ধাপে একেকটা জায়গায় পৌঁছানোর পর টাকা পরিশোধ করেছি আমরা।”
তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পরে একজন স্থানীয় অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঐ ব্যক্তিকে, যিনি তাদের এজেন্টের পূর্ব পরিচিত, তাকে দশ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
ইসলাম জানান, ঝুঁকি সম্পর্কে তারা জানতেন।
“এক বছর আগে আমার খালাত ভাই গেছে, সে ভালো আছে, যে কারণে আমরা সাহস করলাম। আর আমেরিকা যাইতে তো অত ঝুঁকি নাই, কারণ একমাত্র পানামার উপকূল ছাড়া কোন নৌপথ নাই, তাই আমরা অতটা টেনশন করি নাই।”
ইসলামের ভাই ভাগ্যবান। সবাই তার মতো নন।
এ বছরের মে মাসে লিবিয়া থেকে ছোট্ট নৌকায় চেপে খুবই বিপদংসকুল পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা গেছেন অন্তত ৪০ জন বাংলাদেশি।
বডি কন্ট্রাক্ট প্রচলিত যেসব দেশে
বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে শ্রমিকেরা কাজ করতে যায়, বডি কন্ট্রাক্টে সেই সব দেশেই লোক পাঠায় এজেন্টরা।
এর মধ্যে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি, স্পেন ও গ্রিসসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, বাহরাইন, লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশেই শ্রমিক পাঠায় এজেন্টরা।
বডি কন্ট্রাক্ট ‘অমানবিক’
বডি কন্ট্রাক্টকে অমানবিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, এটি এক ধরণের ফাঁদ, সচেতনতার অভাবে যে ফাঁদে পড়ে শ্রমিকেরা।
“উন্নত জীবনের আশার পৃথিবীর সব দেশ থেকেই মানুষ উন্নত দেশে যেতে চায়, কয়েকদিন আগে আমরা যুক্তরাজ্যেও দেখলাম লরিভর্তি লাশ পাওয়া গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করা এবং অনিয়মের ক্ষেত্রে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে দায়িত্ব নিতেই হবে।”
এজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করলে প্রতারণা বন্ধ হবে বলে তিনি মনে করেন।
এ বছরের জুনে জাতিসঙ্ঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, যাতে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশকারীর সংখ্যায় বাংলাদেশিদের অবস্থান চতুর্থ।
গত সাত বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যেতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশি।
নিখোঁজ রয়েছেন সাড়ে ১২ হাজারের বেশি মানুষ।
সূত্র : বিবিসি